অত্যাধিক পরিশ্রমে শারীরিক দুর্বলতা। বাহন বিষয়ে সতর্কতা প্রয়োজন। সন্তানের বিদ্যা শিক্ষায় অগ্রগতি বিষয়ে সংশয় বৃদ্ধি। ... বিশদ
পর্ব ২২
আর এক বন্ধু ‘সোমপ্রকাশ’ সম্পাদক দ্বারকানাথ নতুন একটা প্রস্তাব দিলেন-যে বহুবিবাহ করবে, তাকে ট্যাক্স দিতে হবে (পাঁচশো টাকা!)। ধনীর পক্ষে সম্ভবপর হলেও যে সব দরিদ্রের কুঁজো হয়েও চিৎ হয়ে শোয়ার ইচ্ছের মতো একাধিক বিয়ে করার ইচ্ছে হবে- তাঁদের কথা ভেবে সরকার এই প্রস্তাব খারিজ করে দিল। এবার বিদ্যাসাগর সরেজমিনে তদন্ত করে ১৭৭টি গ্রামের বহুবিবাহের ঘটনার তালিকা প্রকাশ করে দেখান যে, সেখানে বহুবিবাহ করেছিলেন এমন পুরুষের সংখ্যা ৬৫২। তাঁরা বিয়ে করেছিলেন ৩ হাজার ৫৬৮ টি বঙ্গবালাকে। গড়ে সাড়ে পাঁচজন করে স্ত্রী! এদের মধ্যে ৫৫ বছরের এক যুবক মোট ১০৭টি বিয়ে করেন! সরকার বললে, এই তালিকা অতিরঞ্জিত। কিন্তু বিদ্যাসাগরের পক্ষে কাশীরাজ দেবনারায়ণ সিংহ দাঁড়ালেও কাজের কাজ কিছু হল না। সিপাহি বিদ্রোহ লেগে গিয়েছে ততদিনে। সরকার এই আন্দোলনে জল ঢেলে দিল। বহুবিবাহ রদ আইন পাশ হল না।
হবেই বা কী করে বিরোধী দল যে বেশ ভারি। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত বলে বসলেন, ‘পুরুষের একাধিক বিবাহ সকল অবস্থাতে অধর্ম নয়।’ দেশীয় এই প্রথা রদ করার জন্য আইন পাশ করানো মুশকিল ছিল। এর আরও একটা বড় কারণ মুসলমানদের বহুবিবাহ প্রথার রীতি ও নিজস্ব আইন।
কিন্তু বিদ্যাসাগর মশায় ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র ছিলেন না। তাঁর রসাশ্রিত হৃদয় সহসা ব্যঙ্গপ্রবণ হয়ে উঠল। তিনি পরপর লিখলেন- স্বনামে ‘নিষ্কৃতিলাভপ্রয়াস’ এবং বেনামে ‘অতি অল্প হইল’, আবার অতি অল্প হইল, ‘ব্রজবিলাস’ এবং ‘রত্নপরীক্ষা’— পাঁচখানি পুস্তিকা। এর মধ্যে প্রথম তিনটির বেনামদার ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’, চতুর্থখানি ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোসহচরস্য’ প্রণীত। এই পুস্তিকাগুলি তৎকালীন আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য পড়ার পর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ব্রজবিলাস, রত্নপরীক্ষা— এই সকল গ্রন্থে যে সকল হাসি-তামাসার অবতারণা করা হইয়াছে, তাহা অতীব কৌতুকাবহ। এই রসিকতা সেকালের ঈশ্বর গুপ্ত বা গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যর মতো গ্রাম্যতাদোষে দূষিত নহে; ইহা ভদ্রলোকের, সুসভ্য সমাজের যোগ্য এবং পিতা-পুত্রের একত্র উপভোগ্য। এরূপ উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাঙ্গালা ভাষায় অতি অল্পই আছে এবং ইহার গুণগ্রাহী পাঠকও বেশী নাই।’ মজার কথা এই যে, বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার বিহারীলাল সরকার এই বেনামী রচনাগুলো প্রথমে বিদ্যাসাগরের নয় বলে দাবি করেছিলেন। পরে অবশ্য বলেছিলেন, ‘বাচস্পতি মহাশয় যেরূপ বিদ্যাসাগর মহাশয়কে আক্রমণ করিয়াছিলেন এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় বাচস্পতি মহাশয়কে যেভাবে আক্রমণ করিয়াছিলেন তাহা বিজ্ঞোচিত হয় নাই।’ বেনামী বিদ্যাসাগর নাম দিয়েছেন বাচস্পতিকে ‘খুড়া মহাশয়’ এবং নিজে ভাইপো সেজে বিদ্যাসাগরের একরাশ নিন্দেবান্দা করেছেন পরিচয় গুপ্ত করার জন্যে। বলেছেন, ‘খুড়ো, বুড়ো হয়ে বুদ্ধিহারা হইয়াছেন। বুদ্ধিহারা না হইলে, দুর্বুদ্ধির অধীন হয়ে, আমার পুস্তকের উত্তরদানে অগ্রসর হইতেন না।’ অর্থাৎ ভাইপোর বইয়ের উত্তর দিয়েছেন খুড়ো এবং সে বইটি হল ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’— যা কিনা বিদ্যাসাগর মশায়ের স্বনামে রচিত। ভাইপোর রসিকতাবোধের একটু নমুনা দিই— ‘খুড়ো পৃথিবীর মধ্যে কাহাকেও মানুষ জ্ঞান করেন না। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেন, সংস্কৃতবিদ্যা কেবল তাঁর পেটেই অন্তঃসলিলা বহিতেছে।’ ‘হতভাগার বেটা কি শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল’ ইত্যাদি। বিদ্যাসাগরের বইয়ের উত্তরে ‘খুড়ো’ তারানাথ কুড়ি পৃষ্ঠার একটি উত্তর লিখেছেন। অন্য এক ব্যক্তি তাঁর পরিচয় ‘কস্যচিৎ উচিতবাদন’ ছদ্মনামে ‘প্রেরিত তেঁতুল’ নামে পঁচিশ পৃষ্ঠার একটি উত্তর লিখেছিলেন। সে যাক গে, রসিক বিদ্যাসাগরকে পেলাম, তেমনই পেলাম তিনি ইচ্ছে করলেই চলিত বাংলা যে কত গুছিয়ে লিখতে পারতেন তার প্রমাণ। স্বামী বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরীদের কত আগে যে তাঁর সূচনা করে গিয়েছেন তার উজ্জ্বল প্রমাণ এই বেনামী পুস্তিকা চতুষ্টয়। বহুবিবাহ নিরোধক আইন পাশ হল না বটে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রবাহ শুরু হয়েছিল যে তাতে সন্দেহ রইল না।
তবে এটা আমাদের মনে থাকবে যে তারানাথ বিধবা বিবাহের সমর্থক তো ছিলেনই, বিদ্যাসাগরপুত্র নারায়ণ বিদ্যারত্নের স্ত্রী ভবসুন্দরীকে তিনিই প্রথম বরণ করে বাড়িতে তোলেন বহুজনের আপত্তি সত্ত্বেও।
বিবাহ সংক্রান্ত তিনটি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বিদ্যাসাগর মশায় বিধবা বিবাহের ব্যাপারে জয়যুক্ত হয়েছিলেন। আইন পাশ হয়েছিল, তাঁর অর্থানুকূল্যেই বহুতর বিধবার বিবাহ সম্পাদিত হয়েছিল। তবে, এই বিশ্বাস থেকে তিনি কোনওদিন সরে আসেননি যে বাল্যবিবাহই বৈধব্যের মূল কারণ। এটা একটা সমাপতন কিনা জানি না ১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে ঠনঠনিয়ার ‘সর্ব্বশুভকরী সভা’র মুখপত্র ‘সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা’ নামে যে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, তার প্রথম সংখ্যাতেই বিদ্যাসাগর মশায়ের একটি লেখা পত্রস্থ হয় ‘বাল্য বিবাহের দোষ’ নামে। এটিই ছিল তাঁর সমাজসংস্কার মূলক লেখাপত্রের মধ্যে প্রথম লেখা। এটিকে তিনি এ বিষয়ের ‘উপক্রম’ বলেছেন, অর্থাৎ তাঁর আরও লেখার বাসনা ছিল। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই লেখার পর থেকে ১৮৫২-১৮৭০ এর মধ্যে এই বিষয়ে বহু লেখাপ্রবন্ধাকারে ও পুস্তকাকারে একত্রিত হতে থাকে। এমনকী, ‘বাল্য বিবাহ নিবারণী সভা’ নামে একটি প্রতিবাদী সভাও স্থাপিত হয়। এই বিদ্যাসাগর মশায় পরে ১৮৯১ সালে কী করে ‘গর্ভাধান’ প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন বুঝতে পারি না। তিনিই তো বাল্যবিবাহের দোষের কারণে ‘আমরা অশেষ শ্লেষ ও দুর্দ্দশা ভোগ করিতেছি’ লেখার পরে আরও লিখেছিলেন ‘অস্মদ্দেশীয়রা ভূমণ্ডলস্থিত প্রায় সর্ব্বজাতি অপেক্ষা ভীরু, ক্ষীণ দুর্ব্বল স্বভাব এবং অল্প বয়সেই স্থবিরদশাপন্ন হইয়া অবসন্ন হয়...বাল্যবিবাহই এ সমুদায়ের মূল কারণ হইয়াছে।’
বঙ্কিমচন্দ্র বাল্যবিবাহে শাস্ত্রীয় অনুমোদন আছে বলেছিলেন। বিদ্যাসাগর তা জেনেও শাস্ত্রের পরিবর্তে মানবিকতাকেই সাক্ষ্য মেনেছিলেন। শুধু আমাদের মনে হয়, যিনি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন, নানা আন্দোলন করলেন , যিনি মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেননি— তাঁকেই এক সময় পিতার নির্দেশে চোদ্দো বছর বয়সে বালিকা কন্যা দীনময়ীকে বিবাহ করতে হয়েছিল, পাত্রীর বয়স তখন মাত্র সাত কিংবা আট।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল