বিদ্যার্থীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য উচ্চ ... বিশদ
জহর রায়ের স্ত্রী কমলা রায় যৌবনকালে ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। কমলাদেবীকে জহরের বাবা সতু রায় প্রথম দেখেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালসের অফিস ক্লাবের থিয়েটার শো-এ। কমলা সেদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েছিলেন সেখানে। তাঁর রূপ দেখে প্রথম দর্শনেই তাঁকে ছেলের বউ হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন সতু রায়। কমলাদেবীর আদি বাড়ি চট্টগ্রামে। কলকাতায় থাকতেন বারাকপুরে। বরানগরে কমলাদেবীর মেজদি থাকতেন। সেখান থেকেই সম্বন্ধ দেখা হয়েছিল। ওঁর জামাইবাবু ছিলেন চিত্র পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। তিনি আবার সতু আর তাঁর ছেলে জহরকে ভালো করেই চিনতেন। ফলে বিয়েতে কোনও সমস্যা হল না। ১৯৫০ সালের ২৮ জানুয়ারি কমলাদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় জহর রায়ের।
বিয়ের পরে পরেই কমলাদেবী বিহারের পাটনায় শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। দীর্ঘ ১২ বছর সেখানেই ছিলেন। পরে জহর যখন কলকাতায় পাকাপাকি বাড়ি নেন, তখন কমলাদেবীও কলকাতায় চলে আসেন।
ফিল্মের কোনও ফাংশনে কমলাদেবী প্রায় যেতেনই না। ঘর-সংসার সামলাতেন হাসিমুখে। বাজারহাট, রান্নাবান্না নিয়েই থাকতেন। তাঁর হাতের রান্নাও ছিল চমৎকার। জহর অন্য কারও রান্না পছন্দও করতেন না। সকালবেলা স্নান সেরে জলখাবার খেয়ে জহর চলে যেতেন অমিয় নিবাসে। তারপর দুপুরবেলা আবার বাড়িতে খেতে আসতেন। খেয়ে উঠে খানিক বিশ্রাম নিয়েই আবার অমিয় নিবাস। সেখান থেকে ফিরতে মাঝে মাঝে রাত ১২টা-১টা হয়ে যেত। কোনও কোনওদিন বেশি রাত হয়ে গেলে রাতের খাবার নিয়ে অমিয় নিবাসে যেতেন কমলাদেবী। জহর নিজে ব্যস্ত থাকতেন শ্যুটিং, থিয়েটার, রিহার্সাল এসব নিয়েই। বাজারহাট করারও সময় ছিল না, বাজারে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে মুশকিলও ছিল। পুজোর পর থেকে আবার ফাংশনওয়ালাদের ভিড় বাড়তে শুরু করত। ছেলেমেয়েদের স্কুলেও যেতে হতো কমলাদেবীকেই। কারণ জহর সেসবে যেতে চাইতেন না, গেলে লোকের ভিড় হয়ে যেত। স্ত্রীকে বলতেন, ‘তুমিই যাও। আমি গেলে সকলে ঘিরে ধরে।’
মায়ের রান্নার সুখ্যাতি করছিলেন জহর-কমলার ছোট মেয়ে কল্যাণী রায়। স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন, ‘মায়ের রান্না বাবা এতটাই ভালোবাসত, যে রাত বারোটার সময় অমিয় নিবাসের রাঁধুনি বরেনকাকাকে দিয়ে একবার কাঁচা ইলিশমাছ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিল, খিচুড়ি আর ইলিশ ভাপা করে দিতে। ঘরের অন্যান্য কাজের জন্য লোক ছিল। কিন্তু রান্নার ক্ষেত্রে মাকে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল বাবার যে, রান্নাটা তোমাকেই করতে হবে। ভানুজেঠুও যখন বাড়িতে আসতেন মায়ের হাতের রান্না না খেয়ে যেতেন না। মাকে উনি ছোট বোনের মতো ভালোবাসতেন। শ্যুটিং থাকলে বাবা আর ভানুজেঠু একসঙ্গে মায়ের হাতের রান্না খেয়ে স্টুডিওতে যেতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একবার জন্ডিস হয়েছিল। তখন বাবার কথায় ওঁর জন্য মা-ই রান্না করে স্টুডিওতে পাঠাতেন।’
বাড়িতে যেমন স্ত্রীর রান্না ছাড়া কোনও কিছু মুখে তুলতেন না, বাড়ির বাইরে গেলে আবার নির্দিষ্ট কিছু দোকানের খাবার-দাবারই পছন্দ করতেন জহর রায়। নিউ মার্কেটে গেলে যেমন নিয়ম করে বাদশা বা আমিনিয়ার খাবার ছিল মাস্ট। তেমনই চাংওয়ার চাইনিজ ডিশ বা রংমহলের রাবড়ি ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায় অগ্রগণ্য। কল্যাণী বলছিলেন, ‘খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বাবার আর একটা মজার দিক ছিল। পরের দিন কী খাবে সেটা আগের দিনই লিস্ট করে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিত। কী থাকত না সেই তালিকায়! সব্জি খেতে একেবারে ভালোবাসত না। প্রায় প্রত্যেকদিনই বাজারের ফর্দে থাকত মুরগির মাংস আর মাছ। কই মাছ, মাংস আর ডিম ব্যাগ ভর্তি করে আনতে হতো। মা আর আমার দাদা সব্যসাচী গিয়ে ফর্দ মিলিয়ে সব নিয়ে আসত।’
কমলাদেবীর সৌন্দর্য কেমন ছিল তাঁর একটা আঁচ পাওয়া যাবে মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে জহর রায়ের একটা মজার কথোপকথনে। মাঝে মাঝে থিয়েটারে জহর রায়ের অভিনয় দেখতে যেতেন কমলাদেবী। এরকমই একটা থিয়েটার শো ‘চরিত্রহীন’ চলছিল মিনার্ভা থিয়েটারে। আয়োজনে শিল্পী সংসদ। জহরের সঙ্গে গিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। শিল্পী সংসদের সভাপতি হিসেবে মহানায়ক উত্তমকুমারও সেখানে উপস্থিত। অভিনয় জগতের অনেকেই জানতেন জহর রায়ের স্ত্রী খুব সুন্দরী। উত্তমকুমারের কানেও সেই কথাটা পৌঁছেছিল। কিন্ত কমলাদেবী খুব একটা অভিনয় জগতে যাতায়াত করতেন না বলে তাঁকে অনেকেই চিনতেন না। উত্তমকুমারের সঙ্গে নিজের স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিলেন জহর। উত্তমকুমার তাঁকে নমস্কার জানিয়ে পাশে বসালেন। বসলেন জহরও।
উত্তমকুমারের জহরকে নিয়ে একটু মজা করার ইচ্ছে হল। বললেন,‘জহরদা, রামায়ণে পড়েছিলাম বটে কিন্তু সেটা যে কোনওদিন সামনাসামনি দেখব সেটা ভাবিনি।’
হঠাৎ উত্তমকুমারের মুখে একথা শুনে তো জহর আকাশ থেকে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘রামায়ণের কোন কথা বলছিস রে?’
উত্তমকুমার তখন মিটি মিটি হাসছেন। বললেন, ‘সেই যে, পড়েছিলাম না কার গলায় যেন মুক্তোর মালা। এতদিন ভাবতাম ওটা কথার কথা। এখন বউদির পাশে তোমাকে দেখে কথাটার সত্যতা খুঁজে পেলাম।’
স্ত্রীয়ের সামনে উত্তমকুমারের মুখে একথা শুনে জহর রায়ের চোখমুখ তো লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন কয়েক মুহূর্তেই। মঞ্চে স্ক্রিপ্ট ভুলে গেলে ইম্প্রোভাইজেশন করে যেমন ম্যানেজ করে নিতেন অনায়াসে, এক্ষেত্রেও সেই বুদ্ধি প্রয়োগ করলেন। উচ্চকণ্ঠে উত্তমকুমারের দিকে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোর রামায়ণ পড়া সার্থক রে উত্তম। তুই যার কথা বলছিস সে তো তোরই পূর্বপরুষ। তবে, তার সঙ্গে আমার সামান্য তফাৎ আছে। তুই যার কথা বলছিস সে হনুমান। সে সীতা-রামের ভক্ত, আর আমি অন্য রামের (মদ)। এবার বুঝলি?’
উত্তমকুমার মোক্ষম জবাব পেয়ে তারিফ না করে পারেননি।
(ক্রমশ)
ছবিতে স্ত্রী কমলা রায়ের সঙ্গে জহর রায়
ছবি: সৌজন্যে কল্যাণী রায়
অলঙ্করণ: চন্দন পাল