উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
অভিষেকের দু’দিন পর, ২২ জুন এসেছিল শতরান। মহারাজকীয় শতরানের পর জিওফ্রে বয়কট নামকরণ করেছিলেন ‘প্রিন্স অফ কালকুটা’। যদিও, কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। উল্টোদিকে, একের পর এক পড়ছিল শচীন তেণ্ডুলকর, অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাদেজার উইকেট। কিন্তু, অবিচল ছিলেন সৌরভ। দ্বিতীয় দিনের শেষে ২৬ নট আউট। তৃতীয় দিনের লাঞ্চে অপরাজিত ৬৫ রানে। ক্রিকেটের প্রাচীন অরণ্যপ্রবাদ হল, ব্রেক মানেই মনঃসংযোগে টান। জীবনের প্রথম টেস্ট ইনিংসে তাই মারাত্মকভাবে সতর্ক থাকতে হয়েছিল। আর তাই ড্রেসিং-রুমে ফিরে লাঞ্চ পর্যন্ত করেননি। দ্বাদশ ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, খাবার তিনি নিজে গিয়ে এনে দেবেন কি না। রাজি হননি সৌরভ। একবেলা না খেয়ে থাকা যাবে, কিন্তু, মনঃসংযোগে চিড় পড়ার সামান্যতম আশঙ্কাকেও ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না!
অথচ, স্কোরবোর্ডে শুধুই রসকষহীন পরিসংখ্যান। সব বাধা পেরিয়ে জীবনের এমন জয়গান সেখানে অনুপস্থিত। ছাপার অক্ষরে শুধুই তিন নম্বরে নেমে ৩০১ বলে ১৩১ রানের শুষ্ক তথ্য। ২৩ বছর বয়সি কী পাহাড়প্রমাণ বোঝা দু’কাঁধে নিয়ে ক্রিজে গিয়েছিলেন, তা গরহাজির। অনুপস্থিত প্রেক্ষাপটও। ছয় ঘণ্টার ইনিংসে ডমিনিক কর্ক, ক্রিস লুইস, অ্যালান মুলালি, পিটার মার্টিনদেরই তো নয়, খেলতে হয়েছে অনেক অদৃশ্য বোলারকেও। ওই সফরে নেটে তো বটেই, প্রস্তুতি ম্যাচ থেকে সুযোগ পাওয়া একমাত্র ওয়ানডে, সর্বত্রই ব্যাট হাতে নজর কেড়েছিলেন সৌরভ। কিন্তু, তারপরও ঠাঁই হয়নি বার্মিংহামে সিরিজের প্রথম টেস্টে। সেখানে দুই স্পিনার খেলানোর বিলাসিতা দেখিয়েছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। অথচ, ফর্মে থাকা বাঁহাতিকে বসতে হয়েছিল রিজার্ভ বেঞ্চে!
ইতিহাস সাক্ষী, সেবারের ইংল্যান্ড সফর বঙ্গসন্তানের কাছে ছিল কেরিয়ারের ‘ডু অর ডাই’ অ্যাসিড টেস্ট। হয়, সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া। না হলে, কলঙ্ক গায়ে মেখে চিরদিনের মতো অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া। একটা ভুল মানেই ধারালো গিলোটিন নেমে আসা।
অনন্ত চাপ মাথায় নিয়ে কেমন ব্যাটিং করেছিলেন সৌরভ? প্রাক্তন পেসার মামরের স্মৃতিচারণ, ‘ক্রিজে গিয়ে সব ব্যাটসম্যানই শুরুতে নার্ভাস থাকে। কিন্তু, সৌরভকে তা মনে হয়নি একটুও। অভিষেক টেস্টে ব্যাট করছে বলে বোঝাই যায়নি। অফসাইডে ও যে মারাত্মক শক্তিশালী, পরাস্ত করা মুশকিল, জানা ছিল। তার সঙ্গে শর্টপিচ ডেলিভারিগুলোও দারুণভাবে সামলেছিল। অভিষেকে টেস্ট শতরান মানে তো দুরন্ত পারফরম্যান্স। আর স্বপ্নের ব্যাটিংই করেছিল সৌরভ। দলের মধ্যেও নানা সমস্যা ছিল। কিন্তু, সেসব যেন নাগালই পায়নি। একেবারে অন্য জগতে দেখাচ্ছিল সৌরভকে।’ ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরলেন মোঙ্গিয়াও, ‘ভারতীয় ক্রিকেটের পক্ষে সেই টেস্ট ছিল যুগান্তকারী। ফের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল একটা পর্বে। যে দাপটে সৌরভ ব্যাট করেছিল, তা ভোলার নয়। কে বলবে, সেটা ওর জীবনের প্রথম টেস্ট ছিল! দলকে টেনে নিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। সৌরভের ইনিংসই স্বস্তি আনে শিবিরে।’
ক্রিকেট নয়, এ যেন জীবনেরই কাহিনি। খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে বাজিমাত। বা, এ যেন বক্সিং রিংয়ে লড়াই। বিপক্ষ ক্রমাগত মেরে চলেছে ঘুষি। রক্তাক্ত শরীরে পড়ে যাওয়া বক্সার শুনতে পাচ্ছে রেফারির কাউন্টডাউন। আর তখনই অদম্য মানসিক শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে নক-আউট পাঞ্চে জয় ছিনিয়ে নেওয়া। সবুজ ঘাসে ছিটকে যাওয়া সুরভিত স্ট্রোকগুলোর প্রতিটা সেজন্যই হয়ে উঠেছিল অবিচারের প্রতিবাদ। শতরানের উদযাপনে তাই মিশেছিল কারাগার থেকে মুক্তির স্বতঃস্ফূর্ততা।
মামরের কথামতো সেই সফরে পারিপার্শ্বিক আবহও অস্বস্তির ছিল। ক্রমাগত পরাজয়ে গুমোট বাড়ছিল ড্রেসিং-রুমে। নভজ্যোত সিং সিধুর দেশে ফিরে আসা বাড়িয়েছিল অশান্তি। অথচ, ধ্যানমগ্ন সাধকের মতোই ছিলেন সৌরভ। অর্জুনের পাখির চোখে দেখেছেন বোলারের হাত থেকে ছিটকে বেরনো লাল গোলাকে। ব্যাট করতে যাওয়ার আগেই কল্পনায় স্টান্স নিয়ে খেলেছেন ডমিনিক কর্কদের। কেমন বল আসতে পারে, মনে মনে করে গিয়েছেন শ্যাডো। শতরানের পর চায়ের বিরতিতে হাততালির বন্যার মধ্যে ড্রেসিং-রুমে ফিরছেন সৌরভ। তাঁকে সামনে এগিয়ে দিলেন আর এক অভিষেককারী রাহুল দ্রাবিড়। ড্রেসিং-রুমে ঢুকছেন, অভিনন্দনে ভরিয়ে দিলেন সতীর্থরা। টুকরো টুকরো মুহূর্ত। যাতে প্রতিফলিত স্বীকৃতি। শুধু ক্রিকেটপ্রেমীদেরই নয়, দলের অন্দরমহল থেকেও। অপমান থেকে মর্যাদা। পাল্টে গেল সৌরভের দুনিয়া, ওই একটা ইনিংসেই। লর্ডসে সুরভিত অভিষেক তাই জীবনের হার-না-মানা জয়গানই!