কর্মসূত্রে বিদেশ যাত্রার প্রচেষ্টায় সফল হবেন। আয় খারাপ হবে না। বিদ্যা ও দাম্পত্য ক্ষেত্র শুভ। ... বিশদ
নিতান্ত ঘরকুনো কিছু মানুষকে বাদ দিলে গড়পড়তা বাঙালি বরাবরই বেড়াতে খুব পছন্দ করে। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থেকে আমাদেরও মনটা আকুপাকু করছিল, কীভাবে একটু কাছে দূরে বেড়িয়ে আসা যায়। ফলে এবার পুজোর ছুটি মিলতেই আমরা দুই সহকর্মী মিলে বেরিয়ে পড়লাম বাইক সফরে। আমাদের এবারের গন্তব্য ছিল চাকাডোবা ঝিলিমিলি। ঝাড়গ্রাম জেলার একেবারে শেষ প্রান্তে এই ঠিকানা, আর কিছুটা এগলেই ঝাড়খণ্ড। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা সময় কাটানোর যেখানে তাড়াহুড়োর কোনও বালাই থাকবে না। এমন একটা সফর যেখানে গন্তব্যর চেয়ে পথটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
বাইক সফর, তাই কিছু সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। স্বাভাবিকভাবেই বারবার আবহাওয়ার রিপোর্ট নিতে হয়েছে আর একবার আবহাওয়া দপ্তর থেকে অল ক্লিয়ার মিলতেই আমরাও বেরিয়ে পড়লাম জয় মা দুর্গা বলে। শহুরে কোলাহল, লোকজন, ধুলোর মধ্যে বাইক সফর করে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে আমরা যখন ঝাড়গ্রামে পৌঁছলাম তখন আমাদের বাইকের ইন্ডিকেটর দেখাচ্ছে আর ৬৫ কিলোমিটার গেলেই ঝিলিমিলি।
সুন্দর পিচ ঢালা রাস্তায় বাইক গড়াতেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। মালভূমি অঞ্চলের মধ্যে হওয়ায় রাস্তার ওই উঁচুনিচু ঢালগুলো বাইক সফরে একটা আলাদা আনন্দ এনে দেবে। অবশ্য বাইক কেন, যে কোনও গাড়িতে গেলেই আপনি সেই অনুভূতিটা পাবেন, অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করবে, এই পথ যদি না শেষ হয়...!
একটু এগতেই দু’পাশের রং ধীরে ধীরে গেল বদলে। রাস্তার, গাছের, বাড়ি ঘরদোরের সব কিছুই একেবারে অন্যরূপে ধরা দিল চোখের সামনে। দু’পাশে শাল, সেগুন, ইউক্যালিপটাসের ঘন বন। রাস্তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাম না জানা কত না ফুলের বাহার! এরকমই একটি ফুলের বাগিচা দেখে থমকে গেলাম। বাইক থামিয়ে চেয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। আবার শুরু করলাম বাইক সফর। মনে মনে ধন্যবাদ দিই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে, সেই সৃষ্টিকর্তাকে যিনি রূপে রসে গন্ধে ভরিয়ে তুলেছেন আমাদের এই জগৎ, এই প্রকৃতি। এর পাশাপাশি টবের বাহারি ফুল বাহুল্য মনে হতে বাধ্য।
যেতে যেতেই পেরিয়ে এলাম বেলপাহাড়ি, দহিজুড়ি। ইচ্ছে করলে থেকে যেতেই পারেন বেলপাহাড়ি বা দহিজুড়িতে। আরেকটু এগলেই কুলডিহি পার করে দেখে নিতে পারেন খান্দারানি জলাধার। জলাধার থেকে ফিরে আবার মূল রাস্তা ধরে চাকাডোবা-ঝিলিমিলির পথে। আর যেতে যেতেই সূর্য কখন যেন পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে, আবার রং বদলাতে শুরু করেছে গাছপালার মাথায় মাথায়। এক অপার্থিব সৌন্দর্য আপনাকে বাধ্য করবেই গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে দু’দণ্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়তে। এবার রাতের আস্তানা খোঁজার পালা। চাকাডোবা ঝিলিমিলিতে বেশ কয়েকটা জঙ্গল রিসর্ট, হোমস্টে আছে মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যেই। যারা বেড়াতে গিয়ে একটু নিরিবিলি খোঁজেন তাঁদের জন্য একেবারে আদর্শ।
পরের দিন আমাদের প্রথম গন্তব্য লালজল পাহাড় আর লালজল গুহা। সকালের চা-জলখাবার খেয়ে বাইক নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া গেল। চাকাডোবা থেকে ঝাড়গ্রামের রাস্তায় একটু পিছিয়ে এসে পাহাড়ি গ্রামের পথ ধরতে হবে। কখনও ধীরে ধীরে পাহাড়ের উপরে চড়া, আবার কখনও হুড়হুড় করে নীচে নেমে আসা। তবে সারা পথেই কিন্তু আপনাকে খুব সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে, কারণ প্রচুর আলগা পাথর ছড়িয়ে আছে রাস্তার উপরে। হালকা কুয়াশা মেখে আর পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমরা পৌঁছে গেলাম লালজল পাহাড়ের পায়ের নীচে। বাইকটা কোথায় রাখব ভাবতে ভাবতেই
দেখি একজন গার্ড বেরিয়ে এলেন একটা ছোট্ট গুমটি ঘর থেকে। তিনি নিশ্চিত করলেন, ওটাই লালজল পাহাড়। আর পাহাড়ের উপরে সেই লালজল গুহা।
৬০-৭০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের উপরে দেখলাম একটি মন্দির। আমরা এবার পাথর ভেঙে হাঁটতে শুরু করলাম। মন্দিরের চাতালে বসে একটুক্ষণ জিরিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আর উপরে ওঠা ঠিক হবে কি না। যাইহোক শেষমেশ গুহার টান উপেক্ষা করতে না পেরে আবারও চড়াই ভাঙা। গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পা দুটো যে কাঁপেনি তা অস্বীকার করব না। তবে টানটান সোজা হয়ে দাঁড়ালে নীচের এক অন্য পৃথিবীকে আবিষ্কার করার মোহ আপনাকে জড়িয়ে ধরবেই। গুহার ছাদ বেশ নিচু, ফলে তার ভেতরে ঢোকার লোভ সংবরণ করতে হবে। আর বাইরে থেকে যতটুকু আলো এসে ঢোকে তা দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখাও যায় না।
এবার ফিরতি পথে চাকাডোবা ঝিলিমিলি হয়ে তালবেড়া ড্যাম। গ্রাম পেরিয়ে জনমানবশূন্য সরু পথ দিয়ে যেতে যেতে বুকটা একটু দুরু দুরু করে বইকি। দু’একজন পথচলতি মানুষ যাকেই জিজ্ঞেস করি, সেই বলে, এই তো সামনে। শেষ পর্যন্ত ড্যামের উপরে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ হলেও ড্যামে এখনও যথেষ্ট জল আছে। ইচ্ছে করলে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ানো যায়, আবার দলবল জুটিয়ে ড্যামের একপাশে পিকনিকের ব্যবস্থাও করা যায়। তবে আমি বলব কাকচক্ষু জলের ধারে নতজানু হয়ে বসে প্রথমেই ধন্যবাদ দিন প্রকৃতি দেবীকে এই অপার সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে তোলার জন্য। আরামে, আহ্লাদে সময় কাটিয়ে গাছের ছায়ার দিকে তাকালে মন না চাইলেও ফিরতে হয়। তবে ফেরার আগে কথা দিতেই হল, আবার আসব।
কীভাবে যাবেন : ট্রেন বা বাসে ঝাড়গ্রাম। ওখান থেকে বাস বা প্রাইভেট গাড়ি করে চাকাডোবা, ঝিলিমিলি।