পুজোপাঠে ও সাধুসঙ্গে মানসিক শান্তিলাভ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কর্মোন্নতি ও উপার্জন বৃদ্ধি। ... বিশদ
যে দিকে তাকান সবুজে সবুজ। অদূরে দুলকি চালে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে শিলাবতী। স্থানীয়দের কাছে সে ঘরের মেয়ে, শিলাই। উপরে সার সার কাজু ও হরেকরকম বুনোগাছ এবং নীচে বহমান শিলাবতীর মাঝে প্রায় ৭০ ফুট গভীর আগুনরঙা গিরিখাত বা ক্যানিয়ন। আমেরিকার অ্যারিজোনায় কলোরাডো নদীর তীরে সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ক্ষুদ্র সংস্করণ হল শিলাবতীর পাড়ে, ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’ গনগনি। বছরের পর বছর প্রাকৃতিক নিয়মে শিলাবতী নদীর প্রবাহ, স্রোত এবং দিক পরিবর্তনের ফলে ভূমিক্ষয়ের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে এমন সব উদ্ভূত ভূমিরূপ! যা দেখে মনে হবে কোনও সুদক্ষ শিল্পী তার সুনিপুণ কারিগরি দক্ষতায় এবং অফুরন্ত সময়ের বিনিময়ে এমন সব নিখুঁত ভাস্কর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে চলুন, ঘুরে আসা যাক।
নিস্তব্ধ নিঝুম ঘুমন্ত শহরের সীমানা ছাড়িয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছি। আঁধারের শামিয়ানা ছেড়ে ক্রমে আলোর আভা ফুটে উঠছে। একসময় আলো ঝলমল এক নতুন সকাল হাজির হল। দু’নয়ন জুড়ে প্রকৃতির রাজ্যের রূপ আস্বাদন করছি। বম্বে রোড ধরে আরও এগিয়ে কোলাঘাট হয়ে ঢুকে পড়েছি পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকে। এখান থেকে বাকি পথটা ভারি মনোরম। পথের দু’ধারে ঘন শালের জঙ্গল। একসময় এ জঙ্গল মাওবাদীদের আস্তানা ছিল। আরও একটু এগিয়ে আরাবাড়ি ফরেস্ট রেঞ্জ। এরপর আমলাগোড়ার গভীর জঙ্গল। এ জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যেই হাতি বেরিয়ে আসে। এলিফ্যান্ট করিডরও নজরে পড়ল। যাইহোক, এ-ই সমস্ত কিছু অতিক্রম করে প্রায় ন’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম গড়বেতার গনগনি পর্যটন কেন্দ্রে।
এবার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামার পালা। চারপাশে বুনোফুল এবং প্রজাপতির মেলবন্ধনের মাঝে এমন সব বিচিত্র রূপ— কোনওটা গুহার মতো, কোনওটা মন্দিরের আকারে গড়া, কোনওটার গায়ে সূক্ষ্ম বিচিত্র সব খাঁজ ও ভাঁজ, কোনওটা আবার পাহাড়ের মতো আকৃতি নিয়েছে। এইসব ভূমিরূপের বর্ণনা করা বেশ কঠিন! এ সত্যি এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা!
তবে গনগনির এই খাদ তৈরির পেছনে রয়েছে এক পৌরাণিক আখ্যান। পুরাণমতে পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাস কালে নদীতীরের এই গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই সময় এই জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে তাণ্ডব চালাত বকাসুর নামের এক রাক্ষস। প্রতিদিন তার আহারের জন্য এক একজন গ্রামবাসীকে আত্মাহুতি দিতে হতো। তো একদিন ওই ব্রাহ্মণ পরিবারের পালা আসে। মাতা কুন্তীর নির্দেশে বকাসুরের সামনে তখন হাজির হন ভীম। ভীম আর বকাসুরের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলে। তারই ফলশ্রুতি শিলাবতীর তীরে এমন গভীর খাদ! বকাসুর বধ করে ভীম এই গ্রামকে রক্ষাও করেছিলেন।
এই জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। চুয়াড়-লায়েক বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক অচল সিংহ তাঁর দলবল নিয়ে গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন গনগনির জঙ্গলে। গেরিলা যুদ্ধকৌশলও রপ্ত করেছিলেন। ইংরেজদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন তিনি। ইংরেজ বাহিনী কামান দেগে জ্বালিয়ে দিয়েছিল জঙ্গলটাকে। তবুও চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে গিয়েছেন। তবে শেষরক্ষা করতে পারেননি। বগড়ির শেষ রাজা ছত্র সিংহ ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের। এই গনগনির মাঠেই নাকি অচল ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি দিয়েছিল ইংরেজ সরকার।
ক্যানিয়ন সফর সেরে উপরে উঠে এলাম। এগিয়ে চললাম অদূরেই শিলাবতীর পাড়ে নবনির্মিত পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন নিগমের গড়ে তোলা আস্তানার দিকে। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে বিলাসবহুল কটেজে থাকার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় সুখকর হবে। তিনটি কটেজ রয়েছে এখানে। কটেজগুলোর নামও চমৎকার। স্থানীয় নদীর সঙ্গে মিলিয়ে। কংসাবতী, ডুলং ও সুবর্ণরেখা। কটেজগুলোর শেষপ্রান্তে রয়েছে একটি নজর মিনার। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে উপরে চড়লাম। ওখান থেকে একলহমায় বহুদূর পর্যন্ত তিরতির করে বয়ে যাওয়া শিলাবতী, আগুনরাঙা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন আর শিলাবতীর দু’পাড়ের অফুরন্ত সবুজ প্রকৃতি এবং দূরে দূরে ছবির মতো ছোট ছোট গ্রামের দৃশ্য নয়ন জুড়িয়ে দিল। এখানে না চড়লে বহু দূর বিস্তৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যসুখ থেকে বঞ্চিত হতাম! স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে আলাপ হল। কথায় কথায় জানালেন, কখনও কখনও এখানে নাকি হাতিও চলে আসে। আগের রাতেই আমলাগোড়ার জঙ্গলের পথে তিনি হাতিকে রাস্তা অতিক্রম করতে দেখেছেন। শুনে বিস্ময় চেপে রাখতে পারলাম না! কারণ, ও পথেই এসেছি আবার ফিরবও।
এখন দুপুর, মেঘমুক্ত আকাশ। সূর্যদেব গনগনির মাথার উপর একেবারে গনগন করছে। তবে শুনেছি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে রঙের খেলা চলে। তখন এখানের পরিবেশ ও প্রকৃতি অপার্থিব মায়াবী রূপে ধরা দেয়। মনে কোনও খেদ না রেখেই যে রূপ দেখলাম তা সঙ্গে নিয়ে নেমে পড়লাম নজর মিনার থেকে। এগিয়ে গেলাম কটেজের উল্টোদিকে ছোট ছোট দোকানগুলোয়। হালকা জলখাবার খেয়ে উঠে পড়লাম। ঝরনা, পাহাড়, সমুদ্র সফরের পাতায় বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের এক চমৎকার স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে চললাম মল্লভূমের পথে...।
কীভাবে যাবেন : সড়কপথে কলকাতা থেকে কোলাঘাট, শালবনি হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন গনগনি। হাওড়া থেকে পুরুলিয়াগামী ট্রেনে গড়বেতা স্টেশন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটো করে পৌঁছে যান গনগনি।
কোথায় থাকবেন : গনগনিতে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের পর্যটক আবাস। এছাড়া গড়বেতায় ছোট-বড় হোটেলও রয়েছে।