কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। দূর ভ্রমণের সুযোগ। অর্থ প্রাপ্তির যোগ। যে কোনও ... বিশদ
না, থাকে না। তখন নাটকটির উত্তরণ ঘটে। ছুঁয়ে যায় সমসময়কে। আধুনিক যুগকে, আধুনিক ভাবনাকে। আধারটি গ্রিক ট্যাজেডির হলেও নাটকটি হয়ে ওঠে ভীষণভাবেই চিরকালীন বা যাকে বলে ক্ল্যাসিক। এটাই চমৎকারিত্ব ব্রাত্য বসুর লেখনির। গ্রিক ট্যাজেডির মোড়ক অক্ষুণ্ণ রেখে অদ্ভুত পারদর্শীতায় নাটকের নানা মুহূর্তে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছেন আধুনিক সমাজকে, বিদ্রুপ করেছেন রাজনৈতিক মুর্খতাকে, গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে সংলাপে ঝরে পড়েছে শ্লেষ। আর দর্শকাসন থেকে উড়ে এসেছে করতালি ধ্বনি।
নাটকের নাম ‘রানি ক্রেউসা’। ব্রাত্য বসুর লেখা একটি মৌলিক গ্রিক ট্যাজেডি। গ্রিক ট্যাজেডির যেসব বিশেষত্ব থাকে তার প্রায় সব ক’টিই উপস্থিত এ নাটকে। রানি ক্রেউসাই এই নাটকের প্রোট্যাগনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্র। অদৃষ্টের পরিহাসে তিনি পড়েন এক অদ্ভুত সংকটে। যার জেরে তাঁর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। ক্রেউসা আথেন্সের রাজা ইরেকথিয়াসের চতুর্থ কন্যা। তার বিয়ে হয় রাজা যেথাসের সঙ্গে। কিন্তু তাদের কোলে কোনও সন্তান আসছিল না। সন্তান কামনায় রাজা যেথাস স্মরাণপন্ন হন দেবতা আপোল্লন বা অ্যাপোলোর। আপোল্লন বলেন, বেশ কিছুদিন বাদে যেথাস ও ক্রেউসার কোলে আসবে ডোরাস নামে একপুত্র সন্তান। কিন্তু তার আগে আপোল্লনের মন্দিরের সেবক আওন নামের এক কিশোরকে দত্তক নিতে হবে তাদের। আওনই হবে রাজা যেথাসের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ডোরাস বড় হওয়ার পর অবশ্য আওন সিংহাসন ছেড়ে দেবে তাকে। কিন্তু এই ব্যবস্থা মানতে রাজি নয় রানি ক্রেউসা। ক্রেউসার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই যেথাস আওনের অভিষেকের ব্যবস্থা করে। কিন্তু ক্রেউসা আওনের জীবনহানির ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে নিজের একান্ত অনুগত এক ভৃত্যের সাহায্যে। এর পরেই মোড় ঘোরে কাহিনীর। আপোল্লনের মন্দির থেকে এক সেবিকা এসে হাজির হয় ক্রেউসার সঙ্গে দেখা করতে। সেই সেবিকা কিছু গোপন খবর দেয় রানিকে। আর তাতেই মাথা ঘুরে যায় রানির।
রানি ক্রেউসার ভূমিকায় ভীষণ খেটে অভিনয় করেছেন নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। বিশেষ করে তাঁর শরীরী অভিনয় প্রশংসাযোগ্য। তাঁর স্বরক্ষেপন, বাচিক অভিনয়ও মন্দ নয়। কিন্তু যাঁদের শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় সমৃদ্ধ গ্রিক ট্যাজেডি দেখার বা অন্তত শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিংবা যাঁরা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত আন্তিগোনে দেখেছেন তাঁদের কাছে এই ধরনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রের অভিনেতাদের থেকে আরও বেশি কিছু চাহিদা থাকে। বিশেষ করে কণ্ঠমাধুর্য। ঠিক এই জায়গাতেই পিছিয়ে এ নাটকের অভিনেতারা। পাস মার্ক পাবেন না রাজা যেথাসের ভূমিকাভিনেতা সাহেব চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁকে সংলাপ বলার ধরন অর্থাৎ স্ক্যানিং এবং মডিউলেশন নিয়ে অনেক ভাবতে হবে। তবে তিনি যথেষ্ট চেষ্টা যে করেছেন তা তাঁর অভিনয়ে ধরা পড়ে। সাহেবের চমৎকার চেহারা অবশ্য এই চরিত্রের পক্ষে বেশ মানানসই। স্বভাবসুলভ অভিনয় করে দর্শকের মন কেড়েছেন সুপ্রিয় দত্ত। তিনি এই নাটকে রাজার হয়ে যুক্তি লড়াইয়ে নেমেছিলেন গ্লকাস রূপে।
এই গ্লকাস চরিত্রটি এই নাটকে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁর মুখ দিয়েই অনেক দরকারি কথা বলিয়েছেন নাটককার। গণতন্ত্রের দরবারে যখন বিচার চলছে রানি ক্রেউসার তখন গ্লকাস বলছে, ‘যে দেশের আইন ধর্মের মোড়কে বাঁধা হয়, যারা সে আইন করে, প্রথমে বিপদে পড়ে তারা। আমাদের তাই উচিত, প্রথমে রাষ্ট্রনীতি থেকে রাজনীতিকে এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করা...। নইলে চক্ষুষ্মান হয়েও আমরা ক্রমে ক্রমে অন্ধ হয়ে উঠব।’
এই সংলাপ থেকেই পরিষ্কার যে, নাটকের মোড়কটি গ্রিক ট্র্যাজেডির হলেও, একটি নিটোল গল্পের আধারে আসলে তা আমাদের বর্তমান সমাজের, শাসন ব্যবস্থার, আইনি ব্যবস্থার যে খুঁতগুলি রয়েছে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিশ্বব্যপী যে গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে রেখেছে শাসককূল সেটা যে কতটা মেকী তা মনে করিয়ে দেয় রাজা যেথাস। যখন সে বলে, ‘গণতন্ত্রে মূর্খদের বাকস্বাধীনতা যেদিন থেকে আমর মেনে নিয়েছি, সেদিন থেকে রাজআজ্ঞার বল যে হ্রাস পেয়েছে, এ সবাই জানে।’ বিপ্লবী বামপন্থীরা তো এই মেকী গণতন্ত্রের বিরোধিতাই করে!
সব শেষে আসা যাক পরিচালনার বিষয়ে। খুব ভালো ডিজাইন করেছেন নীল মুখোপাধ্যায়। নাটক চলাকালীন যেভাবে কাহিনীর পরিণতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘আপস্টেজে’ ধীরে ধীরে দেবতা আপোল্লনের মূর্তিটি পূর্ণতা পায় সে ভাবনা দুর্দান্ত। ভালোলাগে রানি ক্রেউসাকে দিয়ে একটি লাল কাপড়কে ব্যবহার করিয়ে ব্যঞ্জনাময় দৃশ্যকল্পও। প্রতিটি দৃশ্যের ব্লকিং, কম্পোজিশনের পিছনে নীল যে তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্কটি ব্যবহার করেছেন তা বোঝাই যায়। নাটককার ও নাট্যকারের সফল যুগলবন্দি দেখা যায় এই নাটকে।
এই নাটক পূর্ণতা পেত না যদি না নাটকের সঙ্গীত ভাবনার পিছনে থাকতেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, যদি না থাকত পার্থ মজুমদারের সুচিন্তিত মঞ্চভাবনা। সৌমেন চক্রবর্তী রচিত আলো-আঁধারির মায়াজাল দৃশ্যকাব্যকে প্রস্ফুটিত করে সুচারুভাবে।