বিষ্ণু বসু ও নীতিকা বসু স্মারক বক্তৃতা
বিষ্ণু বসু ও নীতিকা বসুর স্মৃতিতে প্রতিবছরের মতো এবারও দু’দিন ধরে বক্তৃতাসভার আয়োজন করেছিল কালিন্দী ব্রাত্যজন।
বিষ্ণু বসু স্মারক বক্তৃতা
প্রথমদিনের অর্থাৎ বিষ্ণু বসু স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল – অভিনেতা ও নির্দেশকের সম্পর্ক। প্রবীন নাট্যাভিনেতা পঙ্কজ মুন্সির উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে একটা চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়। এরপর এদিনের বক্তা, গৌতম হালদার, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মনোগ্রাহী বচনভঙ্গি, সাবলীলতা ও কৌতুকবোধের মধ্যে দিয়ে চমৎকার বক্তব্য রাখেন।
নট ও নাট্যকার মূলত তাঁর অভিনয় জীবনের তেত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কিছু কিছু নির্দেশকের কথা তুলে ধরেন, যাঁদের সঙ্গে কাজ করে তিনি তৃপ্ত, আপ্লুত এবং সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর প্রথম জীবনের গুরু, হর ভট্টাচার্জর কথা দিয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন গৌতম। ইনিই সেই নির্দেশক, যিনি তাঁকে বৈজ্ঞানিক অভিনয়ের পাঠ দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তিপূর্ণ এবং বলিষ্ঠ বক্তৃতায় উঠে এসেছে রুদ্রপ্রসাদ, দেবেশ, সুমন, বিপ্লব, ব্রাত্য, দুই দেবাশিস সহ এস কৃষ্ণানজির কথা। শম্ভু মিত্রের সঙ্গে সেই অর্থে কাজ না করলেও তাঁকে গুরু মেনেছেন, যেহেতু এক সময় তিনি এই মহান নাট্যকার ও অভিনেতার অভিনয় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।
একজন সবল অভিনেতা ও একজন দুর্বল নির্দেশক, কিম্বা উল্টোটা যদি হয়, অথবা একজন দুর্বল অভিনেতা এবং দুর্বল নির্দেশক, বা একজন সবল অভিনেতা ও একজন সবল পরিচালক একসঙ্গে যদি কাজ করেন, তাহলে কী কী সুবিধে বা কী কী অসুবিধে হতে পারে তার এক বাস্তব এবং চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন গৌতম। যা উপস্থিত প্রতিটি তরুণ নাট্যকর্মীকে নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত করল, তা বলাই বাহুল্য। একজন নির্দেশকের যন্ত্রণাকে যদি একজন অভিনেতা মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করতে পারেন, তবে তিনিই তো সবল অভিনেতা। তেমনই একজন অভিনেতার চাওয়া পাওয়াগুলোকে যদি একজন পরিচালক ঠিকঠিক লক্ষ্য করতে পারেন, তিনিই তো সবল পরিচালক।
গৌতমের বক্তব্যের পর উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকবৃন্দ সেদিনের বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রাখেন অভিনেতার কাছে। যে তালিকায় ছিলেন স্বয়ং ব্রাত্য বসু। যাঁর পিতা-মাতার স্মৃতিতেই এই বক্তৃতা সভার আয়োজন। গৌতমও মহা উৎসাহে সব প্রশ্নের উত্তর দেন।
অজয় মুখোপাধ্যায়
নীতিকা বসু স্মারক বক্তৃতা
একজন চিত্রশিল্পী তাঁর সৃষ্টিকে মঞ্চসজ্জার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে নাটকের উপস্থাপনায় কতখানি অপরিহার্য হয়ে ওঠে সেকথাই শোনালেন স্বয়ং শিল্পী হিরণ মিত্র। ‘থিয়েটার-যা দেখেছি’ বিষয়ে তাঁর দীর্ঘ আলোচনায় নানা অভিজ্ঞতার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর শিল্পসত্তাকে। কালিন্দী ব্রাত্যজন আয়োজিত ‘নীতিকা বসু স্মারক বক্তৃতায়’ গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিল্পীর একেবারে ছোটবেলার শিক্ষার কথা দিয়ে শুরু করেন। সেখান থেকেই তাঁর রং-তুলির সঙ্গে পরিচয়। প্রথম জীবনে তাঁর হাতেখড়ি হয় একজন পটুয়া ও সাইনবোর্ড আঁকার শিল্পীর মাধ্যমে। সেইসময় ইউরোপীয় শিল্প শিক্ষার ধারা এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন এ দেশে অস্বচ্ছ জল রংয়ে কাজ হতো। স্বচ্ছ জল রংয়ের প্রচলন এখানে ছিল না। সেইসময় ইউরোপিয়ানরা শাসন করত। তারা হিউমিলিয়েট করত এখানকার মানুষদের। আর্টের বিপ্লব ঘটে গেল ইউরোপে। বাজার সৃষ্টির জন্য তাদের তৈরি রং, তুলির ব্যবহার করতে হবে এরকম একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল তখন।
এর কিছুদিন পর আর্ট কলেজে আসেন তিনি। সেখানেই জোছন দস্তিদারের নাটক ‘সিরাজদৌল্লা’তে যুক্ত হন। ‘আমি নাটককে মনে করি তিলোত্তমা। এর মধ্যে অনেক আর্ট ফর্ম, অভিব্যক্তি জড়িয়ে আছে। নাটক আমার কাছে জীবন্ত চরিত্র। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নানারকম আর্টের প্রয়োগ হয়ে ওঠে। নাটকের গতিময়তা ছবি আঁকাতেও আসে। নাটকের রিহার্সাল দেখাটা আমার কাছে কোরিওগ্রাফ দেখার মতো। যেমন সিনেমা দেখার চেয়ে তার ‘রাশ’ দেখাটা মজার।’ নাটকের মহড়াকে দৃশ্যবদ্ধ করি, আঁকতে থাকি। যখন নাটক পাঠ হয়, চরিত্র নির্বাচন হয়েছে বা হয়নি, সেই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন ভার্জিন সময়, শুধুমাত্র ধ্বনি আছে। ধ্বনি দূরত্ব আছে। চরিত্রটাকে চিত্রণ করে। সংলাপের কাঠামো আছে তার মধ্যে চিত্র আছে। সেই সময় দৃশ্য কল্পনা করতে পারি। থিয়েটার ডকুমেন্ট। নিজের ছবির কল্পনার মধ্যে সংযোগ করি। ব্যাক স্টেজে যে গল্প হয় সেকথাও বলেন। নিজস্ব নাটক দেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, একজন শিল্পীকে নিয়ে যখন বায়োগ্রাফিক্যালি কাজ হয়, তখন সেই শিল্পীর ভাবনা ও দর্শনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। অভিনেতাদের প্রাথমিক কাজ অভিনয় করা। শম্ভু মিত্র, গ্যালিলিওর প্রসঙ্গ এনে বলেন, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে মঞ্চের চরিত্রের সম্পর্ক। শিল্পী হিসাবে তাই চরিত্র হিসাবে দেখার ও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছি। নাটককে সম্মিলিত যৌথ কর্মশালার মতো মনে হয়। ভিস্যুয়াল অর্কেস্ট্রেশন মনে হয় নাটককে। মঞ্চে অ্যাবস্ট্রাকশন নিয়ে কাজ করেছি নাটকে। আলো, পোশাক, শব্দ প্রক্ষেপণের সঙ্গে কথা বলে আলোচনা করে নিই। বাংলা অকাদেমি প্রেক্ষাগৃহে আয়োজিত এই আলোচনায় উপস্থাপকের ভূমিকায় ছিলেন সুব্রত ঘোষ।
কলি ঘোষ
10th August, 2019