নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
সেই অতীতের গল্পকথায় ড. শঙ্কর ঘোষ।
কবিগানের সেরা গায়ক ভোলা ময়রা উঠতি এক ফিরিঙ্গির কবিয়াল হওয়ার ইচ্ছাকে নস্যাৎ করার জন্য কবিগানের আসরে গাইলেন—
‘‘তুই জাত ফিরিঙ্গি জবর জঙ্গি-পারব না কো তরাতে
শোন্ রে ভ্রষ্ট, বলি স্পষ্ট, তুই রে নষ্ট, মহা দুষ্ট।
তোর কী ইষ্ট, কালী কেষ্ট? ভজগে যা তুই, যীশু খ্রিস্ট
শ্রীরামপুরের গির্জেতে।’’
দমবার পাত্র নন সেই ফিরিঙ্গি কবি; তিনি প্রত্যুত্তরে গেয়ে উঠলেন—
‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও তো কোথা শুনি নাই।’
সেই ফিরিঙ্গি আর কেউ নন। তিনি হলেন অ্যান্টনী ফিরিঙ্গি। কবিয়াল হিসাবে সর্বদা তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছেন তাঁর স্ত্রী সৌদামিনী। এই নিয়ে জমজমাট নাটক ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’। রচনা বিধায়ক ভট্টাচার্যের। প্রধান তিনটি চরিত্রের শিল্পী হলেন সবিতাব্রত দত্ত (অ্যান্টনি), কেতকী দত্ত (সৌদামিনী), জহর গঙ্গোপাধ্যায় (ভোলা ময়রা)। মঞ্চস্থ হচ্ছে কোথায়? না, মানিকতলার খাল পাড়ে অবস্থিত ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে’। এ নাটক টানা ৫১৪ রজনী অভিনীত হয়ে এ মঞ্চকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা দিল। পরে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ‘মল্লিকা’ নিয়ে, সন্ধ্যা রায় ‘সুজাতা’ নিয়ে, মাধবী মুখোপাধ্যায় ‘না’ নিয়ে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘নামজীবন’ নিয়ে, অনুপকুমার ‘অঘটন’ নিয়ে, সর্বোপরি অপর্ণা সেন ‘পান্নাবাঈ’ নিয়ে সরগরম করে রেখেছিলেন এই মঞ্চ। তার আগে কে চিনত এই মঞ্চকে! নান্দিক-এর তরফে কেতকী দত্তের তত্ত্বাবধানে খালপাড়ের এই মঞ্চে যখন অভিনয় হবে বলে সবাই তৈরি, তখন অনেকের মনে ভাবনা হল খালপাড়ে যাবে কে? মাথা খাটিয়ে খাটিয়ে সে পথ বার করলেন কেতকী দত্ত। গভর্নমেন্ট বাস যার একটা যাবে সাউথ ক্যালকাটা, আরেকটা যাবে হাওড়া, অপরটা যাবে নর্থ ক্যালকাটা। তিনটে বাস তিনটি রুটে যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হল। খালপাড়ের মঞ্চ, মশার ডিপো, দর্শকদের মশা কামড়ালে কেউ আসবে?
কেতকী দত্ত অন্যান্যদের নিয়ে শো-এর আগে স্প্রে করে মঞ্চ বন্ধ করে দিতেন। শো-এর ঠিক আগে মঞ্চ খুলে দেওয়া হতো। এই নাটক শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর। সকলের মধ্যে একটা স্পিরিট কাজ করত। নইলে জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের মত দুর্ধর্ষ নট কাউন্টারে এসে বসে টিকিট বিক্রি করতেন! প্রথম দুটো অ্যাক্ট-এ তাঁর চরিত্রের প্রবেশ ছিল না। তারপর যখন তিনি ঢুকতেন আর ওই বৃদ্ধ বয়সে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গাইতেন—
‘আমি সে ভোলানাথ নই আমি সে ভোলানাথ নই
আমি ময়রা ভোলা, হরুর চেলা, বাগবাজারে রই’, তখন দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন।
‘অ্যান্টনী কবিয়াল’ সেই সময়ে কে না দেখেছেন। সবার আগে উল্লেখ করার মতো নাম প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। তিনি এলেন। তাঁকে সংবর্ধিত করা হল। দেখলেন এ নাটক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ইন্দিরা গান্ধীর এই নাটক দেখতে আসার একটা বড় বাঁধানো ছবি টিকিট কাউন্টারের বিপরীত দিকের দেওয়ালে ঝোলানো ছিল বহুদিন। শুধু ইন্দিরা গান্ধী কেন? উত্তমকুমার, কিশোরকুমার, কানন দেবী, তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর, বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ স্বামী রঙ্গনাথানন্দজি প্রমুখ স্মরণীয় মানুষেরা এ নাটক দেখতে এসেছেন বা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু ভিতরের দলাদলিতে হাউসের মালিক তালা ঝুলিয়ে দিলেন। কোর্ট কেস করে তালা ভাঙা হল ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ঢুকে দেখা গেল সব মালপত্তর সব বেপাত্তা। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে কেতকী দত্ত আবার শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা আর ফলপ্রসূ হয়নি।
মুখ্যত পেশাদার শিল্পী হলেও আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে অভিনয় করেছেন বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারে। চতুর্মুখের সদস্যপদ নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ৩০ জুন। এই চতুর্মুখের প্রযোজনায় ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট প্রতাপ মঞ্চে (রাজাবাজার ট্রাম ডিপোর বিপরীতে) শুরু হল সুবোধ ঘোষের লেখা ‘বারবধূ’। নাট্যরূপ নির্দেশক চতুর্মুখের প্রধান অসীম চক্রবর্তী। সেখানে নায়িকা লতার চরিত্রে কেতকী দত্ত। নায়ক প্রসাদ-এর চরিত্রে অসীম চক্রবর্তী। তুমুল বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন কেতকী দত্ত। কারণ নাটকের প্রথম দৃশ্যে শুধু একটা অন্তর্বাস আর সেমিজ পরে প্রসাদের সঙ্গে যৌন দৃশ্যে অভিনয় করছেন, মুখে গানও রয়েছে; ‘আমি চাইনা চাইনা চাইনা তোমার ওজন করা ভালোবাসা।’ গোড়ার দিকে বিক্রি ভালো ছিল না। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিক্রি তেমন নেই। একদিন হঠাৎ করে অসীম চক্রবর্তীর মাথায় এল পাবলিসিটির জন্য নতুন এক স্লোগান— ‘ভালোবাসার ব্লো হট নাটক।’ এই যেই পাবলিসিটি পড়ল, আস্তে আস্তে বিক্রি বাড়তে বাড়তে রোজ হাউসফুল। একাদিক্রমে ১৮০০ রজনী অভিনীত হয়ে এ নাটক এক ইতিহাস সৃষ্টি করল। নাটকটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কেতকী দত্ত কিন্তু শেষের রজনীগুলিতে অভিনয় করতে পারেননি।
কারণ ‘বারবধূ’র জনপ্রিয়তা কেতকী দত্তকে নিয়ে। সবাই এসে বলতেন কেতকী অপূর্ব, কেতকী অতুলনীয়, কেতকী একাই একশো ইত্যাদি ইত্যাদি। অসীম চক্রবর্তীর মনে কমপ্লেক্স গ্রো করল। যার জন্য মেন্টাল আর ফিজিকাল টর্চার আরম্ভ করলেন অসীম চক্রবর্তী কেতকী দত্তের ওপরে। স্টেজের মধ্যে পর্যন্ত টর্চারিং হতো নিয়মিত। হাত দুটো অসীম এমনভাবে ধরতেন যে, পাঁচটা আঙুলের ছাপ পড়ে যেত। সিনের শেষে যেই লাইট অফ হতো, মুখটা অসীম নিয়ে আসতেন কেতকীর কাঁধের কাছে, জোরে কামড় বসিয়ে দিতেন। কেতকী যত ভালো অভিনয় করেন, তত বেশি টর্চার চলত। দুমদাম মার। একদিন থাকতে না পেরে সিন থেকে বেরিয়ে এসে কেতকী এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। অসীম স্পষ্ট বললেন, ‘যদি চরিত্রটা না দিতাম, কে চিনত কেতকী দত্তকে?’ চুপ করে থাকতে পারলেন না কেতকী দত্ত; ‘শোনো তুমি ভুল বললে। কেতকী দত্তকে অনেকে চেনে। তোমার বারবধূ’র থেকে কেতকী দত্তকে চেনে না। অ্যান্টনী কবিয়াল-এর কেতকী দত্তকে চেনে। তা ছাড়া তুমি তো স্রষ্টা। তুমি তো লতা চরিত্রটা সৃষ্টি করেছ। আমি তাতে রূপ দিয়েছি। রূপটা সার্থক হয়েছে বলেই দর্শকেরা ভালো বলছে। এতে তোমার আনন্দ পাওয়ার কথা। এতে তোমার রাগ হয় কেন?’ কে শোনে কার কথা। মাঝে কেতকী দত্তকে বসিয়ে দিয়ে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আসা হল লতা চরিত্র করার জন্য। দর্শকদের মন ভরলো না। আবার সেই কেতকী দত্তকে আনা হল। সিনের মধ্যে একটু-আধটু ভুল হলে আবার টর্চার। একদিন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘ভুল মানুষ মাত্রেই হয়।’ যেই বলা, দুম করে এক ঘুঁষি। নাকটা ফেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে আরম্ভ করল। উইংসের আড়ালে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এর মধ্যে আর ঢোকেন না। কারণ এ যে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সেই অপমানিত কেতকী দত্ত নাটকের জগতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী প্রভা দেবীর মেয়ে। ২০০২ সালে তিনি ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি’ পুরস্কার পেয়েছেন। অনেক নাটকে মঞ্চ দাপিয়ে বেরলেও তাঁকে নাট্যমোদীরা মনে রাখবেন ‘অ্যান্টনী কবিয়াল’-এর সৌদামিনী এবং ‘বারবধূ’ নাটকের লতা চরিত্র দুটির জন্য। মৃত্যুর পূর্বে এক স্মৃতিচারণে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, আর বোধ হয় পাবলিক থিয়েটার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পাবলিক থিয়েটার মরে গেছে।’