স্বদেশের বা বিদেশের নামী প্রতিষ্ঠানে বিদ্যালাভের সুযোগ পেতে পারেন। সব কাজে কমবেশি সাফল্যের যোগ। আয় ... বিশদ
দ ঝলমলে দিন। পাহাড়ি নদীর উপর ছোট্ট সাঁকো। কিন্তু নড়বড়ে, ভাঙাচোরা। সাঁকো পেরলে নদীর স্পর্শ পাওয়া যাবে। ছোট পাথর সাবধানে এড়িয়ে বড় পাথরে বসে খানিক জিরিয়ে নেওয়াও সম্ভব। কিন্তু সাঁকো পেরতে পারলে, তবে তো! যেতে পারব কি? দ্বিধায় যে পড়েছি, তা দূর থেকে দেখেই বোধহয় বুঝেছিলেন বছর চল্লিশের মুসলিমা। ‘দিদি আমার হাত ধরুন’— কে ডাকে?
কাশ্মীরের দুধপথরিতে সেদিন বাঙালি টুরিস্ট নিতান্তই কম। বরফ পড়বে আর কয়েকদিনের মধ্যেই। ঢেকে যাবে দুর্গম পাহাড়ি পথ। এমন জায়গায় স্পষ্ট বাংলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছেন কে! সালোয়ার কামিজ, সোয়েটার, মাথা ঢাকা ওড়নার মাঝে হাসিমুখ ততক্ষণে এগিয়ে এসেছেন অনেকটাই। হাত ধরে সাঁকো পার করে দিলেন যত্নে। তারপর আবদারের সুরে বললেন, ‘নদী থেকে ফিরে আমার দোকানে এসে চা খাবেন।’
পাকা ব্যবসায়ী বুদ্ধি। সঙ্গে ভালোবাসার উষ্ণতা। মুসলিমার দোকানে কাশ্মীরি কাওয়া নিয়ে যখন বসলাম, রোদ্দুর তখন পিঠে আরামের সেঁক দিচ্ছে। জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। টুরিস্টের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। চা, ম্যাগি, রুটির অর্ডার আসছে পরপর। দ্রুত হাত চালাচ্ছেন মুসলিমা। সঙ্গী স্বামী এবং ছোট মেয়ে। কাশ্মীরের দুধপথরির একমাত্র বাঙালি মহিলা দোকানদার মুসলিমা দোকান সামলে শুরু করলেন গল্প।
কাশ্মীর ভ্রমণে দুধপথরি টুরিস্টদের চেনা স্পট ঠিকই। কিন্তু বেশিরভাগ ভ্রমণার্থী সেখানে যান, এমন নয়। তার মধ্যে বাঙালি আবার হাতে গোনা। ফলে বহুদিন পরে বাংলায় কথা বলতে পেরে মুসলিমার কথার ঝুলি সেদিন বাঁধনহারা। আদতে মুর্শিদাবাদের মেয়েটি ২০ বছর আগে পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিল। পরিবারে দারিদ্র ছিল। বড় সংসার। ফলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া নিয়ে চিন্তা ছিল তাঁর বাবা, মায়ের। সেখানে হঠাৎই এক কাশ্মীরি ট্রাকচালকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন মুসলিমার মা। মুসলিমার জীবন হয়ে উঠল ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’।
সেই থেকে কাশ্মীরে সংসার পেতেছেন। তিন সন্তানের জননী মুসলিমা এখন নিজেই ব্যবসা শুরু করেছেন। নানা ধরনের কাজ করার পর তাঁর স্বামীও এখন দুধপথরিতে স্ত্রীর দোকানে সাহায্য করেন। দোকানের মূল কাণ্ডারী মুসলিমাই। ‘আমাদের গ্রাম মুসপথরি। দুধপথরি থেকে দু’ঘণ্টা হেঁটে যেতে হয়। প্রতিদিন হেঁটেই যাতায়াত করি। শাহি কাওয়া, মকাই রুটি, সর্ষে শাক, চা, ম্যাগি, আচার সব পাওয়া যায় আমার দোকানে।
আমার এক ছেলে, দুই মেয়ে। ওরা পড়াশোনা করে। মাঝেমধ্যে সময় পেলে দোকানে
আসে। আমরা দু’জনই থাকি সবসময়’,
বললেন তিনি।
সকালে সংসারের রান্না। বৃদ্ধ শ্বশুর, শাশুড়ির দেখভাল। তারপর দোকানের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে দুধপথরির রাস্তায় হাঁটা শুরু করেন মুসলিমা। পাহাড়ে অন্ধকার ঝুপ করে নেমে আসে। ফলে শেষ দুপুরেই দোকানে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। টুরিস্টের ভিড় থাকলে বিকেলের শেষ আলোয় বন্ধ হয় ঝাঁপ। ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরেন ক্লান্ত মুসলিমা। পাহাড়ি রাস্তায় দু’ঘণ্টা হাঁটা তো কম নয়। ফিরে গিয়ে ফের রাতের রান্না করতে হয়। এ তো প্রচুর খাটনি! হাসিমুখে বললেন, ‘খাটতে হবে দিদি। না খাটলে হবে না। বাড়ি করতে গেলে খাটতে হবেই।’ হাসির আড়ালে কোথাও কি বিষণ্ণতা ছুঁয়ে গেল মুসলিমার চোখ? মুর্শিদাবাদ যাওয়ার সুযোগ হয় এখন? ঝটিতি উত্তর, ‘বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে দিদি। পরবের সময় মুর্শিদাবাদের কথা খুব মনে পড়ে। কিন্তু কী করব? এখন তো এখানেই সব। কখনও তিন বছর কখনও আবার পাঁচ বছরও হয়ে যায়, বাড়ি যাওয়া হয় না।’
২০ বছরে অনেকটা বদলে গিয়েছে মুসলিমার জীবন। ভরা সংসারে তিনিই এখন কর্ত্রী। শুধু বাঙালি টুরিস্ট নয়। যে কোনও ভ্রমণার্থীকেই যেচে সাঁকো পার হতে সাহায্য করতে এগিয়ে যান তিনি। টুরিস্টরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন। তা শুনেই মুসলিমা বুঝে নেন কোন ভাষায় বাক্যালাপ করলে খুশি হবেন তাঁরা। প্রাথমিক কথোপকথনের পর হাসিমুখে নিজের দোকানে আসার অনুরোধ করেন তিনি। মার্কেটিংয়ের অ আ ক খ শিখেছেন মাঠে নেমে। কেউ হাতে ধরে শিখিয়ে দেয়নি। সংসার সামলাতে নিজেই হাল ধরেছেন যখন, ঠেকে শিখেছেন সবটা। সন্তানরা আপনার থেকে শিখছে দোকানের কাজ? ‘ওরা দোকানে এলে দেখে। শেখে। কিন্তু ওরা পড়াশোনা করুক, সেটাই চাই’, স্পষ্ট জবাব দিলেন মুসলিমা। বড় মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন মা। পড়াশোনার শেষে সংসারী হোক সে, মুসলিমা সেটাই চান। মেয়েদের বিয়ে কোথায় দেবেন? দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘কাশ্মীরেই মেয়েদের বিয়ে দেব। আমার মা আমার জন্য কেঁদেছে। আমি আমার মেয়েদের জন্য কাঁদতে চাই না। ইচ্ছে হলে ওদের যেন দেখতে পাই, সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।’
কাশ্মীরি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। কাশ্মীরি রান্না শিখেছেন। মুর্শিদাবাদ তাঁর জীবনে এখন ধূসর চ্যাপ্টার। বাংলার মাটি, হাওয়া মুসলিমার দৈনন্দিনে সিপিয়া টোন এনেছে। তাও দুধপথরির ভিউ পয়েন্টে, পাহাড় ঘেরা নদীর ধারে বাঙালি টুরিস্ট দেখলে মুসলিমা যেন কিশোরীবেলায় ফিরে যান। বাংলা ভাষায় কথা বলে অভিমানী মনকে শান্ত করেন। নিজের হাতে তৈরি নানা খাবার টুরিস্টদের খাওয়াতে পেরে ঠিক যেন মাতৃত্বের প্রশান্তি তাঁর মুখে। দিনান্তে ছোট্ট বটুয়া ভরে ওঠে। লক্ষ্মীলাভে খুশির ঝিলিক খেলে যায় মুসলিমার চোখে। একটা একটা করে পয়সা জমছে ভাঁড়ে। নিজের একটা বাড়ি হবে তো?