আয় বৃদ্ধি ও গৃহসুখ বৃদ্ধি। কর্মস্থলে সাফল্য ও প্রশংসা লাভের সম্ভাবনা। শরীর-স্বাস্থ্য বুঝে চলুন। ... বিশদ
জীবনটা যে আদৌ সিনেমা নয়, তা বাস্তবের কঠিন মাটি বুঝিয়ে দিয়েছে ঝুনু দেবনাথকে। ছোট স্বপ্ন, একচিলতে সুখ নিয়ে গড়া পরিবার ছায়াহীন হয়ে পড়ে তাঁর কর্তার মৃত্যুর পর। কর্তা অর্থাৎ বিলাস দেবনাথ। কাটিহারের বাসিন্দা বিলাসের প্যান্ডেল তৈরির ব্যবসা ছিল। বছর ছয়েক আগে তাঁর অকালপ্রয়াণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন গিন্নি ঝুনু। এক পুত্র এবং এক কন্যাসন্তানকে নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়। আর্থিক সঙ্কট মধ্যবিত্ত দিনযাপনে আঁচড় বসায়। কী করবেন, কোথায় যাবেন ভাবতে ভাবতে দিশেহারা ঝুনু প্রয়াত স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেন। ধীরে ধীরে তাঁর কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। মহিলা প্যান্ডেল শিল্পী হিসেবে তাঁকে ভরসা করে কাজের বরাত দিতে শুরু করেন নামী পুজোর কর্মকর্তারা। লড়াই করে আজ অনেকটাই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন ঝুনু।
‘এই ব্যবসা মূলত আমার স্বামীই করতেন। তখন আমার ছেলে তখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সবে বেঙ্গল আর্ট কলেজে পড়াশোনা শুরু করেছে। মেয়ের ১২ বছর বয়স। স্বামী মারা যান। প্রবল আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিলাম। খুব অসহায় লাগত। ছেলের পড়াশোনা, মেয়ে ছোট, তারও পড়াশোনা রয়েছে। তখন উপায় না দেখে নিজেই এই ব্যবসা শুরু করলাম। তারপর আবার করোনা এল। খুব চাপের মধ্যে সংসার চালিয়েছি। আমার কিন্তু ডেকরেটরের ব্যবসা নয়। দুর্গাপুজো, কালীপুজোর থিমগুলো আমরা করি’, বলছিলেন ঝুনু।
পুজোর আগে তিনি প্রবল ব্যস্ত। এবার একসঙ্গে পাঁচটা পুজো প্যান্ডেলের কাজ চলছে তাঁর বাড়িতেই। পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণেশ্বরের হিন্দমোটর, অশোকনগরের ভারতী ক্লাব, গোবরডাঙার একটি প্যান্ডেল এবং বাদুড়িয়ার মণ্ডপ তৈরির দায়িত্ব রয়েছে ঝুনুর। প্রতিটা মণ্ডপের থিম তো আলাদা? ঝুনুর উত্তর, ‘অবশ্যই আলাদা। অশোকনগরের থিম হল ব্যাঙ্ককের বৌদ্ধ মন্দির। গোবরডাঙার থিম মুক্তি। বাদুড়িয়ায় হচ্ছে বাংলার লোকশিল্প। দক্ষিণেশ্বরে সবুজায়নের উপর কাজ হচ্ছে। পরিবেশকে আমরাই ধ্বংস করছি, গাছ কাটছি, সেইসব নিয়েই বার্তা দেওয়া হবে। আর পশ্চিম মেদিনীপুরের প্যান্ডেলে কলকাতা বিষয়ক কাজ হবে, যার নাম সংকল্প। ভালোর সঙ্গে কলকাতায় তো কিছু কষ্টের জিনিসও আছে, সেগুলো মানুষ গুরুত্ব দেয় না। সেটার উপরই তৈরি হবে প্যান্ডেল।’
ঝুনুকে কাজের দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন ক্লাব কর্তারাও। তা স্পষ্ট হল অশোকনগর ভারতী ক্লাবের সেক্রেটারি আনন্দ রায় কর্মকারের কথায়। তিনি বলেন, ‘গত দু’বছরও আমাদের কাজ দিদি করেছেন। আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। গত বছর তো দুর্গাপুজোর সময়ই অন্য একটি ক্লাব কালীপুজোর জন্য আমাদের প্যান্ডেলটাই বুকিং করে নেয়! শিল্পী ‘মহিলা’ বলে আমাদের কোনও ঝুঁকি নিতে হয়নি। এবারও উনি ভালো কাজ করবেন, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত।’
মছলন্দপুরে ছোটবেলা কেটেছে ঝুনুর। বাবা, মায়ের আদরে বড় হওয়া মেয়েটি কখনও ভাবেননি ভবিষ্যতে প্যান্ডেল তৈরিই হবে তাঁর পেশা। ঝুনু স্বীকার করলেন, কাজটা করতে পারছেন এককালে স্বামী পরোক্ষে সাহায্য করেছিলেন বলেই। কীভাবে? তাঁর কথায়, ‘আমার স্বামী একসঙ্গে ১২-১৩টা করে কাজ করতেন। সব সেট আপ বাড়িতেই তৈরি হয়। বিয়ের পর থেকেই ওঁর কাজ দেখেছি। উনি আমার সঙ্গে সব কিছু আলোচনা করতেন। কোথায় কী থিম, কত লোক খাটছে, কত পারিশ্রমিক, সব আলোচনা করতেন। তাই আজ ব্যবসাটা সামলাতে পারছি। নাহলে আমি তো সাধারণ গৃহবধূই। উনি যখন কাজ করতেন, তখন কোনওদিন ফিল্ডে যাইনি। পুজোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলিনি। সবই এখন পারছি, উনি আমাকে সব বলতেন বলেই।’
ঝুনুকে এখন সাহায্য করেন তাঁর ছেলে আকাশ। তিনি বললেন, ‘ছেলে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। আমরা দু’জনে একটা লেআউট তৈরি করি। ভাবনাচিন্তাও করি। ছেলে সঙ্গে আছে সবসময়। নাহলে পাঁচটা কাজ একার পক্ষে করা সম্ভব নয়।’ এই পেশায় পুরুষের আধিপত্য। কিন্তু মহিলা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কোনওদিন সমস্যার সম্মুখীন হননি বলে দাবি করলেন ঝুনু। স্পষ্ট বললেন, ‘মহিলা হিসেবে খুব সম্মান পাই। আমাকে অন্য চোখে দেখেন সকলে। অনেক ক্লাব শুনেছি কাজ করতে গিয়ে টাকা মেরে দেয়। প্যান্ডেলের কাজ করার আগে এটা ভাবেনও অনেকে। কিন্তু আমার সঙ্গে কখনও এমন হয়নি। সবাই জানে একজন গৃহবধূ একাজে নেমেছে মানে তা কতটা ঝুঁকির। তার টাকা এদিক ওদিক করা যাবে না। হয়তো অন্যদের তুলনায় কম পারিশ্রমিকে কাজ করি। কিন্তু যে পরিমাণ টাকাতে চুক্তি হয়, সেই টাকাটাই পাই।’
কাজের পরিবেশ নিয়েও ঝুনুর কোনও অভিযোগ নেই। কাঁচামাল কিনে বাড়িতেই তৈরি করেন কাঠামো। অর্ডার নেওয়ার সময় বা তারপরও নানা প্রয়োজনে তাঁকে ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে হয়। মহিলা বলে কখনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়নি বলেই জানালেন। ‘আমি মনে করি নিজেকে কীভাবে সমাজের সামনে পরিবেশন করব, তার উপরই নির্ভর করে আমাকে সমাজ কী চোখে দেখবে। আমি যদি সকলকে সম্মানের চোখে দেখি, দাদার মতো সম্মান দিয়ে কথা বলি, তাঁরাও তো আমাকে বোন হিসেবেই দেখবে। আমি কাউকে খারাপ বলতে পারব না। এমনও হয়েছে, হয়তো বয়সে ছোটরা ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সরে যায়। সম্মান পাই বলেই ব্যবসাটা করতে পারছি’, বললেন ঝুনু। দুর্গাপুজোর আগে থেকেই ব্যস্ততা শুরু। চলে জগদ্ধাত্রী পুজো পর্যন্ত। সরস্বতী পুজোর সময় কিছু মণ্ডপের থিম তৈরি করেন তিনি। পুত্র ভবিষ্যতে এই ব্যবসার হাল ধরবে। কিন্তু কন্যার এখনও তেমন আগ্রহ নেই। তবে এই পেশায় মেয়েরা আরও আসুক, তা চান তিনি। ঝুনু বলেন, ‘আগে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। আমি কাজের জন্য ৫০-৬০ জন পুরুষের সঙ্গেও কথা বলি। ভদ্র, নম্র ব্যবহার করলে তাঁরা সম্মান দিতে বাধ্য। এটা সম্মানের কাজ। তাই মেয়েরা এগিয়ে আসুন। আপনার শিল্পবোধ কাজে ফুটিয়ে তুলবেন। দেখবেন, এ কাজ ভারি আনন্দের।’