দুর্গা দুর্গতিনাশিনী
চৈতন্যময় নন্দ
দুর্গ বা সংকট হতে যিনি সকলকে উদ্ধার করেন তিনিই দুর্গা। বাংলার মাতৃদুর্গা সারা ভারতে নানা মূর্তিতে অধিষ্ঠিতা, ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতা। পুরীধামে তিনি পূজিতা বিমলা নামে, গুজরাতে ‘অম্বা’ ‘হিঙ্গলা’ ও ‘রুদ্রাণী’ নামে, বিন্ধ্যচলে বিন্ধ্যাবাসিনী, কুরুক্ষেত্রে ভদ্রকালী, বৃন্দাবনে কাত্যায়নী, কামরূপে কামাখ্যা, জম্মুতে বৈষ্ণোদেবী, কন্যা কুমারিকায় কন্যাকুমারী, বারাণসীতে অন্নপূর্ণা, বিজয়ওয়াড়ায় কনকদুর্গা, বৈদ্যনাথে জয়দুর্গা, রাজস্থানে ভবানী আর হিমালয়ে নন্দা। দেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বাজারে, পাহাড়ে-জঙ্গলে, পথে ঘাটে সর্বত্রই দেবীর অধিষ্ঠান। যত দুর্গামূর্তি পূজিতা হন তার মধ্যে চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা ও অষ্টাদশ ভুজা প্রভৃতি মূর্তি প্রসিদ্ধ।
ভারতবর্ষে যে চারটি প্রসিদ্ধ ধামের উল্লেখ আমরা পাই তার মধ্যে অন্যতম পুরীর জগন্নাথ ধাম। শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মূল মন্দিরের দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে দেবী বিমলার মন্দির। এটি একান্নপীঠের অন্যতম মহাপীঠ। আদ্যাশক্তি মহামায়া সতীদেবীর নাভিদেশ এখানে পতিত হয়েছিল। বিখ্যাত আদ্যাস্তোত্রেও দেবী বিমলা দৃপ্তকণ্ঠে বিঘোষিতা। ‘বিমলা পুরুষোত্তমে’। এই সর্বেশ্বরী পরমা জননী আরাধিতা চতুর্ভুজা মূর্তিতে। ত্রিশূল, খড়্গ, খর্পর ও রুদ্রাক্ষ মালা চার হাতে এই চার আয়ুধ। কষ্টি পাথরের দ্বারা নির্মিত দণ্ডায়মানা এই দেবী মূর্তির তিনটি চোখই সোনার।
শারদীয়া দুর্গাপুজোয় অধিষ্ঠিতা এই মহাদেবীর বিশেষ পুজো-অর্চনা চলে মহাসমারোহে। ষোলো দিন ধরে চলে দেবীর ষোড়শোপচারে আরাধনা। এক একদিনে আকর্ষণীয় বেশ। যেমন বগলা, হরচণ্ডী, নারায়ণী, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, রাজরাজেশ্বরী প্রভৃতি মনোহারী সাজসজ্জা দেখা যায়। শারদ মহাষ্টমী ও মহানবমীর মধ্যরাত্রে সম্পাদিত রহস্য পুজোয় দু’টি করে মেষবলি ও আমিষভোগ দেবীকে নিবেদন করা হয়। জগন্নাথদেবের মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় তান্ত্রিক পুজোর আচার অনুষ্ঠান। সে সময় কারও প্রবেশাধিকার থাকে না। ভোর হওয়ার আগেই এই পুজো সম্পন্ন করতে হয়। তান্ত্রিক পূজারী চলে যাওয়ার পর জগন্নাথ মন্দিরের দরজা উন্মুক্ত হয়।
বাঙালির দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠান ‘নবরাত্রি’ হিসাবে দেশের অন্যত্র প্রচলিত। ন’রাত্রি ধরে অনুষ্ঠান বলে নামকরণ তাই ‘নবরাত্রি’। আগেই বলা হয়েছে গুজরাতে দেবীদুর্গা পূজিতা অম্বা, হিঙ্গলা ও রুদ্রাণী নামে। অর্বুদগিরি শৈলমালার ওপরে আসীন অম্বাদেবীর শ্বেতপাথরের নির্মিত সুউচ্চ দৃশ্য মন্দির। সামনে বিশাল প্রাঙ্গণ। পিছনে রমণীয় সরোবরে ভক্তরা স্নান সেরে দেবীর পুজো দিতে আসেন। নানা অলঙ্কারে শোভিতা অম্বাদেবীর অষ্টভুজা প্রতিমা। নবরাত্রে দেবীর মন্দিরের চৌহদ্দিতে হয় সুবিখ্যাত গরবা নাচ। চলে বিজয়া দশমী পর্যন্ত। দেবীসূক্ত, রাত্রিসূক্ত, শ্রীসূক্ত ও সপ্তশতী মহাস্তোত্র রোজ পঠিত হয়। এখানে নবরাত্রির বিশেষ অঙ্গ হিসেবে প্রতিদিন হলুদ, সিঁদুর আর চন্দনকে তেলে গুলে হয় তিলক বিনিময়। মহিলারা অংশ নেন নানাবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে। কুমারী মেয়েরাও ব্রত পালন করেন প্রদীপ দানের মাধ্যমে। প্রতি সন্ধ্যায় দেবী মূর্তির সম্মুখে চলে নাম, গান আর প্রবচন।
চেন্নাই রাজ্যের বিজয়ওয়াড়া পবিত্র কৃষ্ণানদীর উপকণ্ঠে একটি জেলা শহর। মহাভারতে এই পুণ্য সলিলার মহিমা বিবৃত। স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত আছে যে কৃষ্ণানদীতে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের মতোই পুণ্য হয়। কৃষ্ণাঘাটের পাশেই ইন্দ্রকিলা পাহাড়ে এক মনোরম মন্দিরে কনকদুর্গার ভদ্রাসন। নানা অলঙ্কারে বিভূষিতা আগাগোড়া সোনার এই মূর্তি অপূর্ব লাবণ্যময়ী ও প্রসন্নময়ী। চতুর্ভুজা কনকদুর্গা এখানে বরাভয়প্রদা। কথিত আছে এটি একটি উপপীঠ। দেবীর লোম এখানে পতিত হয়েছিল। মহাদেবী এখানে অর্চিতা চণ্ডনায়িকারূপে। আর দেবীর ভৈরব হলেন চণ্ডেশ্বর। মন্দিরে পৌঁছানোর পথে পড়ে অজস্র দোকানপাট, পুজো সামগ্রী ও ফুল-ফলের কেনাবেচা। দুর্গা সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত এখানে মহাসমারোহের সঙ্গে দুর্গাপুজোর পর্ব সুসম্পন্ন হয়। অমিত প্রভাবতী সুদর্শনা কনকদুর্গার এই শারদোৎসবে শহরবাসীর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভক্তি আজও সমভাবে অটুট। জনশ্রুতি যে, দেবী কনকদুর্গার নাসিকার নথ কৃষ্ণানদীর জল যেদিন স্পর্শ করবে ঠিক তখনই শুরু হবে মহাপ্রলয়ের দুর্বিপাক।
দ্বাপর যুগে দেবকীর অষ্টম গর্ভে ভগবান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে কংসের কারাগার আলো করে আবির্ভূত হন। সেই রাতেই গোকুলে যশোদার গর্ভে মহামায়া নন্দ দুহিতারূপে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পর মহাত্মা বসুদেব দৈব নির্দেশিত হয়ে তাঁকে নন্দালয়ে যশোদার কাছে রেখে কন্যাকে সেখান থেকে নিয়ে এসে কারাগারে ফেরেন। দুরাত্মা কংস দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে কারাগারে এসে ক্রোধভরে সদ্যোজাত কন্যাটিকে যখন শিলাতলে ছুড়ে মারতে যান, তখন কন্যারূপিণী মহামায়া হাতছাড়া হয়ে কংসের মাথায় পদাঘাত করেন। সেই সময় এই শিশু এক অপরূপা অষ্টভুজা দেবীমূর্তি ধারণ করে আকাশ পথে উত্থিতা হন এবং কংসের প্রাণ সংহার সূচক দৈববাণী শোনান। তারপরে এই নন্দাদেবী বিন্ধ্যাচল নিবাসিনী হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভ দুই প্রবল অসুরকে যুদ্ধে অচিরেই নিহত করেন। তাই নন্দাদেবীর সর্বাধিক প্রসিদ্ধ নাম ‘বিন্ধ্যবাসিনী’। এলাহাবাদ কিংবা বারাণসীর অনতিদূরে বিন্ধ্যাচল। এখানেই দেবী বিন্ধ্যবাসিনীর অধিষ্ঠান। গঙ্গার তীরে মন্দিরে কষ্টি পাথরের নির্মিত এই সর্বেশ্বরী সিংহবাহিনী পূজিতা অষ্টভুজা মূর্তিতে। প্রতি বছর নবরাত্রির দিনগুলিতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা এখানে আসেন দেবীর দুর্নিবার আকর্ষণে। শোনা যায় এই তান্ত্রিক পীঠে ছিল ভয়ঙ্কর সব আচার অনুষ্ঠান। মনস্কামনা সিদ্ধির জন্য দেবীর কাছে তখন একাধিক নরবলিও পড়ত!
রাষ্ট্ররূপিণী দুর্গতিনাশিনী দেবীদুর্গা ‘তুলজা ভবানী’ রূপে প্রকাশিতা। ছত্রপতি শিবাজি’র আরাধ্যা এই দেবীর উদ্দেশ্য ছিল অশুভ শক্তির দমনে এক মহান স্বরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করা। মহারাষ্ট্রের শোলাপুর শহর থেকে চুয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে পাওয়া যাবে তুলজা ভবানীর মন্দির। এই অপরূপা দেবীর নামানুসারে এই জনপদের নাম তুলজাপুর। মারাঠা জাতির অন্যতম শক্তিপীঠ হিসাবে প্রাচীন এই মন্দিরের খুব প্রসিদ্ধি। গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত তিনফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্ঠি পাথরের অষ্টভুজা দেবী প্রতিমা। আলুলায়িতকেশী এই মহিষাসুরমর্দিনীর পরনে রক্তবস্ত্র ও অঙ্গে বহুমূল্য অলঙ্কার। ভবানীদেবীর আট হাতে যথাক্রমে ত্রিশূল, ছোরা, বাণ, চক্র, ধনুস, পানপাত্র ও অসি সজ্জিত। দেবীর দক্ষিণ পদতলে আসীন অসুররাজ মহিষাসুর আর পাশে বাহন পশুরাজ সিংহ। শিরোভাগে সূর্য আর চন্দ্র। এই দেবীর দৈনিক পুজোর আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে অনেক বৈচিত্র ও বিশেষত্ব বিদ্যমান। দুর্গাপুজো এলেই এই দেবীতীর্থ আরও বেশি করে জেগে ওঠে। মহাষ্টমীতে ভবানী দুর্গার কাছে প্রচুর ছাগবলি প্রদান ও লাল ভোগলার তরকারি (মিষ্টি কুমড়ো) আর এক ব্যতিক্রমী আকর্ষণ। মন্দির প্রাঙ্গণে বসে বিরাট মেলা। লক্ষাধিক পুণ্যার্থীর সমাগমে ও দেবীর জয়গানে মুখরিত হয়ে ওঠে এই মাতৃতীর্থ। দেবী ভবানীর মাহাত্ম্য জনমানসে এত গভীরভাবে প্রসারিত যে, গ্রাম-শহর হতে সর্বস্তরের মানুষ শোভাযাত্রা করে তুলজা ভবানীর ছবি মাথায় করে বা পালকিতে নিয়ে এসে গান করতে করতে সমবেত হন দেবী মন্দিরে। অনেকের মতে দেবী সমীপে এই সংগঠিত শোভাযাত্রার প্রবর্তক হলেন সুবীর শিবাজি স্বয়ং। সমগ্র মারায়া জাতির মনে আজও বিশ্বাস রয়েছে, ছত্রপতি শিবাজির সংকল্প বাস্তবায়নে মা তুলজা ভবানী নিজে প্রকটিত একখানা তরোয়াল প্রদান করে মারাঠারাজকে শক্তি ও প্রেরণা সঞ্চার করেছিলেন। দেশ জয়ের কামনায় এই বীর ছত্রপতির অসি নৃত্য ভারত গঠনে দেশপ্রেমীদের প্রেরণাস্থল।
17th October, 2020