ছোটবেলা থেকেই গড়ে দিতে হবে মেয়েদের স্বাস্থ্য
শৈশব থেকেই কন্যাসন্তানের ডায়েটে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ সে-ই পরবর্তীতে সংসারের কর্ত্রী, ভাবী মা। তার স্বাস্থ্যের ভিত মজবুত হওয়া দরকার। লাইফস্টাইল ও ডায়েট কনসালট্যান্ট রূপশ্রী চক্রবর্তীর পরামর্শ শোনাচ্ছেন সোমা লাহিড়ী।
এখনও আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে কন্যাসন্তানের আদর পুত্রের তুলনায় কম। তাই যত্নও কম। ফলে একটা বয়সে পৌঁছে তাদের অনেক রকম শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। পুষ্টির অভাবই এর মূল কারণ। মেয়েদের সার্বিক পুষ্টির জন্য যে দামি দামি খাদ্য চাই, তা কিন্তু নয়। চাই যত্ন আর সচেতনতা।
• সদ্যোজাত শিশুকে কী খাওয়ানো জরুরি?
•• অবশ্যই ব্রেস্ট ফিড করানো জরুরি। মাতৃদুগ্ধের মতো স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার আর কিছু নেই। এতে প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস, স্যাচুরেটেড ফ্যাট ইত্যাদি সবরকম উপাদান থাকে যা শিশুর পুষ্টি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। শুধু তাই-ই নয়, মাদার’স মিল্ক শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
• বছরখানেক বয়স হলে তাকে কী কী খাওয়াতে হবে?
•• এই সময় দাঁত উঠে যায়। তাই একটু একটু করে শক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। অনেকে বাজার চলতি রেডি সিরিয়াল খাওয়ান। আমি বলব সেটা না করে সুজির হালুয়া, সুজির পায়েস, চালের পায়েস, দুধ-রুটি, খিচুড়ি, ডালিয়ার খিচুড়ি, ডাল সেদ্ধ, সব্জি সেদ্ধ— এই ধরনের খাবার দিন। পুষ্টিও পাবে, ফাইবারটাও প্রথম থেকে শরীরে যাবে।
• ফাইবার কী কী খাবার থেকে পেতে পারে ছোটরা?
•• সব্জি আর ফলমূল থেকে। দাঁত উঠলেই ওদের চিবিয়ে খেতে দিন। আপেল সেদ্ধ নয়, আপেল গরম জলে ভিজিয়ে রেখে দিন। তারপর খুব ছোটো করে কেটে খেতে দিন। কলা, নরম করে সেদ্ধ ডিম দেবেন। ভাত দু’বেলা দেবেন। পাঁচ বছর অবধি এভাবেই চলবে। দিনে ২ গ্লাস দুধ মাস্ট।
• এরপর যখন পড়াশোনা, নানারকম অ্যাক্টিভিটি শুরু হয়, তখন কী ধরনের খাবার দিতে হবে?
•• ছয় থেকে দশ বারো বছর বয়সটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়েই শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ও বিকাশ হয়। স্কেলিটাল গ্রোথ হয়। তাই প্রতিদিনের খাবারে যাতে সঠিক পরিমাণে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হব। বিশেষ করে মেয়েদের ৬০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম প্রতিদিন চাই। তাই দু’বেলা দু’গ্লাস দুধ দিতে হবে। যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে, তাদের ল্যাকটোজ ফ্রি দুধ দিতে হবে। কলা, লেবু, ডিম, মাছ এবং পরিমাণ মতো ভাত-ডাল-সব্জি অবশ্যই থাকবে রোজের ডায়েটে। আর ঘরে পাতা দই খাওয়ানো দরকার। জলখাবারে বা টিফিনে কেনা খাবার, প্যাকেজড খাবার দেবেন না। বাড়িতে হাতে গড়া আটার রুটি তরকারি দিন, চিড়ের পোলাও দিন, সুজির হালুয়া বা পোহা দিন, মাঝেমধ্যে লুচি-পরোটাও দিতে পারেন। ব্রোকোলি, ক্যাপসিকাম টোম্যাটো, গাজর, বিন্স ইত্যাদি দিয়ে স্টু করে দিতে পারেন। রোজ কয়েকটা করে আমন্ড ও ওয়ালনাট দিন। এগুলো ব্রেন ডেভেলপমেন্টে সাহায্য করে এবং ডায়াবিটিস প্রতিরোধ করে।
• বারো-তেরো বছর থেকে তো মেয়েদের আরও অনেক রকম পরিবর্তন হয়। এই সময়ের ডায়েট কেমন হওয়া উচিত?
•• এই সময়ে মেয়েদের হরমোনাল চেঞ্জ হয়। মেন্সট্রুয়েশন সাইকেল শুরু হয়। পড়াশোনার চাপও বাড়ে। হাড় ও পেশীর গ্রোথ সব থেকে বেশি হয়। আর যেটা হয়, এই সময় নিজের মতামত তৈরি হয়, তাই বাইরের খবর, প্যাকেটজাত প্রোসেসড খাবার খাওয়ার ঝোঁক বাড়ে। ফলে এই বয়সের মেয়েদের অনেক রকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে। লাইফস্টাইল ডিজঅর্ডারই এই সব সমস্যার কারণ।
• একটু যদি বুঝিয়ে বলেন সমস্যাগুলো।
•• বিশেষ করে এই বয়সের মেয়েদের খেলাধুলো বা শারীরিক পরিশ্রম খুব কম। স্কুল, টিউশন, বাড়ি ফিরে পড়াশোনা— এর বাইরে স্মার্টফোন নিয়ে সময় কাটানো আর টিভি দেখা ছাড়া কিছু নেই। উইকএন্ডে বাবা মায়ের সঙ্গে বাইরে খাওয়া বা একটু বড় যারা, তাদের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, ব্যস। এর ফলে ওজন বাড়ছে। ইস্ট্রোজেন হরমোন কমছে, টেস্টোস্টেরন হরমোন বাড়ছে। ইনসুলিন সেন্সিটিভিটি বাড়ছে। পনেরো-ষোলো বছর থেকেই পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম দেখা যাচ্ছে যা পরবর্তীতে ওভারিয়ান সিস্ট হয়ে যাচ্ছে।
• তাহলে উপায় কী?
•• লাইফস্টাইলকে অর্ডারে আনতে হবে। ঠিক সময়ে ঘুমোতে হবে, সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। সকালে উঠে বাসি মুখে দু’ গ্লাস জল খেতে হবে। ব্রেকফাস্টে এক গ্লাস দুধ, একটা কলা, একটা ডিম সেদ্ধ মাস্ট। স্কুলে টিফিনে বাড়ির খাবার খাবে। লাঞ্চ এবং ডিনারে ভাত খাওয়া দরকার। কারণ ভাতে আছে ভিটামিন বি১২, যা এই বয়সের মেয়েদের খুব দরকার। ড্রাই ফ্রুটস খেতে হবে। এই সময় মেন্সট্রুয়েশনের কারণে আয়রন ডেফিসিয়েন্সি হতে পারে। সব্জির মধ্যে কাঁচকলা, পেঁপে, গাজর, বিন, টোম্যাটো থাকা দরকার। বাড়িতে পাতা টক দই রোজ খেতে হবে। প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ডাল, সয়াবিন, চিকেন, মাছ খেতে হবে পরিমাণ মতো। বাইরের খাবার মাসে তিন চার দিন খেতে পারে।
• টিন এজাররা স্লিম হওয়ার জন্য খাওয়া কমিয়ে দেয়। এটা তো ঠিক নয়। তাহলে উপায়?
•• একেবারেই ঠিক নয়। এই সময়টাই ফিজিকাল ও মেন্টাল ডেভেলপমেন্ট হয় সবথেকে বেশি। তাই কার্বোহাইড্রেট বন্ধ করা চলবে না। ফ্যাটও পরিমাণ মতো চাই। শুধু প্রোটিন ডায়েট চলবে না। তাই এক্সারসাইজ করে ঘাম ঝরিয়ে স্লিম হতে হবে। খাওয়া বন্ধ করে নয়। সারা জীবন অনেক লড়াই লড়তে হয় মেয়েদের। কেরিয়ার তো আছেই, সেই সঙ্গে সংসারের ধকল, মা হওয়া, সন্তান মানুষ করা। তাই ছোটবেলা থেকে শরীরের ভিত মজবুত করতেই হবে। আর তা সম্ভব কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইল ও সঠিক ডায়েটের মাধ্যমে।
05th September, 2020