উৎসব এবার চেতনার
মৃণালকান্তি দাস
মন খারাপ। খুব মন খারাপ। সব আছে। অথচ কী যেন নেই! জীবনটা যেন এখন লুডোর গুটি। রোজ শুধু ওঠা-নামার খেলা। সবসময় মনে আতঙ্ক। যত না সংক্রমণে তার থেকে অনেক বেশি প্রিয়জনের থেকে দূরে চলে যাওয়ার। সেই নীলকণ্ঠ পাখিটা উড়ে গিয়েছে অজানা কোন অচিনপুরে। কিন্তু এই দুঃসময়েও মানুষ আগামীদিনের সুদিনের জন্য বুক বাঁধে। তাই তো এবারও মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পুজোর তোড়জোড়। ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে শিউলির ডাল। পদ্মের গোলাপি থেকে শিশির পিছলে যাচ্ছে পুকুরের জলে। আসলে প্রকৃতির অন্তরও পুজোয় মাতোয়ারা।
আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই জেগে থাকে অনন্ত অপেক্ষা। কোনও কিছু সত্যি পেয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতীক্ষাই পরমপ্রাপ্তি। অপেক্ষা যত দীর্ঘতর হয়, পাওয়ার আনন্দ তত গভীর। পুজোর অপেক্ষা জিইয়ে রাখার কোনও তুলনা হয় না কি! ঢাকের আওয়াজ। নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ। অঙ্গবস্ত্রের চেয়েও আজ বেশি প্রয়োজন এক চিলতে মুখচ্ছদ। সত্যিই তো কাশফুল এ বছরও নীলচে হয়ে যায়নি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কণ্ঠস্বরও ফিনফিনে হয়ে পড়েনি। টেলিভিশন, খবরের কাগজ পুজোর নতুন বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ। দৃশ্যত কোনও বদল নেই। পাল্লা দিয়ে বাজার-শপিংমল-জুতোজামার দোকানে দূরত্ববিধি বা মাস্ক-বিধি উড়িয়ে ঘেঁষাঘেঁষি আর ঠেসাঠেসির বাড়বাড়ন্ত। তবে ভিড় এড়িয়ে চলার প্রসঙ্গ টেনেই সপ্তপদীর অমর সংলাপ, ‘‘ও যেন আমাকে টাচ না করে!’’ ঘুরেছিল আমার–আপনার মোবাইলেই।
আশা-আশঙ্কার এই আবহে বাঙালির রসবোধের বাহন হয়েছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ। চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, মাস্কবিহীন শির, হাসপাতালে বেড নেই, গড়িয়াহাটে ভিড়... মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে ‘নতুন ছড়া’। ভাইরাল ক’লাইনে শুধু গড়িয়াহাটের কথা থাকলেও শুধু গড়িয়াহাট নয়, হাতিবাগান, নিউমার্কেট— মহানগরের বড় বাজারের সর্বত্রই ভিড় দেখা যাচ্ছিল রোজ। সেই ভিড় দেখেই সমাজমাধ্যমে এমন আশঙ্কার প্রকাশ দেখা গিয়েছে নানা ছন্দে, ছবিতে। পাল্টা জবাবও সমাজমাধ্যমে ঘুরেছে, ‘যায় যদি যাক প্রাণ, জুতো কিনে বাড়ি যান’-এর মতো লাইন। আসলে, পুজোর মুখে দুশ্চিন্তা কিছুটা কাটিয়ে সবে আশার আলো খুঁজেছে আমবাঙালি! এই শারদোৎসব ঘিরেই অন্তত ৮০ হাজার কোটি টাকার বিকিকিনি হয়। সব স্তরের মানুষের উপকার। পুজো মানে শুধু আড়ম্বর নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের আর্থিক যোগদান। অর্থনীতির উপকার। আমাদের এই বাঙালিজনমের মাঝখানটিতে বসে শত শত সামাজিক ওঠা-পড়া যে নিয়ন্ত্রণ করে এই পুজো। টুকরো টুকরো চাওয়াপাওয়া বদলে-যাওয়া এই বাংলার শারদোৎসব ঘিরেই। বহুতল, শপিং মল, ঝকঝকে দোকান-পসরার ফাঁকে-ফোকরে তরী ভাসিয়ে রাখার অসংখ্য অকথিত কাহিনী। ছেঁড়া ছেঁড়া সংলাপ।
তাকিয়ে দেখুন, নীলাকাশে ক্যানভাসে পেঁজা পেঁজা মেঘ। কোন ঋতু? বাঙালি চোখ বুজে বলে দেবে শরৎ। বাতাসে ইদানীং হিমের পরশ টের পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু কাশ এখনও ফোটে। শিউলি ফুলের বোঁটায় এখনও কমলা ঝলকায়। এখনও শরৎ ও দুর্গোৎসব একাত্ম। দুর্গাপুজো গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে উৎসবের ভিড়ে নামিয়ে আনে সমাজের অনেকটা অংশকে। তাতে মিশে যায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের ঢল। মাসের পর মাস বাড়িতে আটকে বসে থাকা মানুষ, স্কুল-বন্ধু-খেলাধুলো ভুলে ঘরবন্দি কচিকাঁচার দল, কোনও রকমে মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস এঁটে সাইকেলে অফিস ঠেঙানো মানুষের দল ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠছে। পুজোর সময় এরা যে মরিয়া হয়ে প্যান্ডেল হপিংয়ে মেতে উঠতে চাইবে, বলাই বাহুল্য! তাহলে কি পুজোর কটা দিন বাঙালি ভুলে থাকবে ‘করোনা-যুদ্ধ’ শব্দবন্ধটা? যুদ্ধবিরতি ঘোষণা? কিন্তু করোনা তো এই বিরতির ধার ধারে না, উৎসবকে পরোয়া করে না। বরং, উৎসব সংক্রমণের অনুঘটক হয়ে দাঁড়াবে কি না, সে আশঙ্কাই বেশি। পুজোর আগল ভাঙা ভিড়ে কোভিড সংক্রমণ যে বাতাসে পাল তোলা নৌকা হয়ে ফিরবে, এ আশঙ্কা ছিলই। পরিসংখ্যান বলছে, মহালয়ার পর সংক্রমণ হু হু করে বাড়তে থেকেছে। ডাক্তারবাবুরাও ত্রাহি-ত্রাহি রব তুলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া মগনলাল মেঘরাজের সংলাপেও যেন তারই প্রতিধ্বনি, ‘‘পুজা মার্কেটিং কোরছেন কোরেন, লেকিন আপনার সেফটির গ্যারান্টি হামি দিতে পারব না।’’ অতএব, কলকাতা হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা জারি। রাজ্যের সমস্ত পুজো মণ্ডপ ‘নো এন্ট্রি’ জোন। মণ্ডপে বন্ধ হোক দর্শক প্রবেশ।
করোনার আবহে এ বছর সবই উলটপুরাণ। নিউ-নর্মালের পুজোও তাই অন্য রকম। মিলনের উৎসবেও এ বার দূরত্ব। ঐতিহ্যের পুজোয় ছেদ সুরের মূর্ছনায়! গয়না না শাড়ি, কাশ্মীর না কন্যাকুমারী—ঘরে ঘরে তর্কের ঝড় নেই। হাতের মেহেন্দি ঢাকবে দস্তানায়, পুজোর পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে জুতো-জামার সঙ্গে মনে করে কিনতে হয়েছে পছন্দমতো মাস্ক। থিম-সম্ভার নিয়ে হইচই ছাপিয়ে যে মণ্ডপে সব থেকে ভিড়, সে-ই ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা থেকে বাগবাজারের সিঁদুরখেলা— সব ২০২১-এর জন্য তোলা। আমরা এবার যেন উৎসব ঘিরে পরীক্ষায় বসেছি। পুজো একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার অন্যায্য দাবি মুখ্যমন্ত্রী মানেননি। বলেছেন, উৎসব হবে, কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে সতর্কতা বিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথা মুখ্যমন্ত্রী বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। কার্নিভাল, বিসর্জন শোভাযাত্রা এবার হবে না, জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। উদ্যোক্তারাও এবার প্রচারে কোনওরকম গুরুত্ব দেননি। থিমের অহঙ্কার নয় বরং, জাঁকজমককে অনেক কমিয়ে, অনুরোধ করছেন, ভিড় জমাবেন না। অন্য বছর ভিড়ের প্রার্থনা। এবার উল্টো। দূরত্ব বিধি যথাসম্ভব মেনে চলা সম্ভব। তাতে আপনি বাঁচবেন, অন্যরাও বাঁচবেন। সুস্থ থাকবেন। আলিঙ্গন নয়, পরস্পরের মধ্যে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখাই হল ‘নিউ নর্মাল’। দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হবে না পুজোর ভোগপ্রসাদ। পুজোবাড়ির অন্দরে প্রবেশে স্বাস্থ্য সতর্কতার পাশাপাশি থাকছে নিয়ন্ত্রণ বিধির কড়াকড়ি। জেলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুজোর ছন্দটাই যেন ওলোটপালট হয়ে গিয়েছে। যেখানে মিলনের উপরেই নিষেধাজ্ঞা, সেখানে উৎসব হয় কী করে?
২০২০ সালটা যে ভালো যাবে না, সেটা বিগত দশকেই আন্দাজ করে ফেলেছিলেন জ্যোতিষবিদরা। কারণ হিসেবে বলেছিলেন ২০২০-র ১২ জানুয়ারি শনি, বৃহস্পতি, বুধ, মঙ্গল ও রাহুর একই বক্রপথে চলে আশা, যা নাকি রীতিমতো আশঙ্কার। গ্রহের এই ফের নাকি এর আগে দেখা গিয়েছিল প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়। আর ১৯৮০-র সাংঘাতিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়। আর এই বছর গোটা পৃথিবী রোগশয্যায়। প্রত্যেক বাঙালির এখন একটাই আশা, মায়ের আগমনে যেন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতে পারে যত রোগ, আবর্জনা, গ্লানি এবং দুঃখ। ফের নতুন ভাবে যেন বাঁচতে শিখতে পারে এই দুনিয়া।
ষাটোর্দ্ধ ব্যক্তিরা সচেতন থেকে এই বছরটা ঘরে থাকুন। পাড়ার পুজো সকাল–সকাল একবার দেখে আসুন। টেলিভিশনে চোখ রাখুন। সামনের বছর অনেক ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য এবার একটু সংযম দেখান। অপেক্ষাকৃত কম বয়সিরা নিজেদের নিরাপদ ভেবে বিপদ বাড়াবেন না। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা কয়েক মাস দিন–রাত এক করে লড়ছেন, আমাদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। বেশ কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই সংক্রামিত হয়েছেন। সেই চিকিৎসা–শক্তিকে চুরমার করে দেবেন না। ভুগতে হবে আমাদেরই। কোনও চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী পুজোর ছুটি উপভোগ করবেন না। ওঁদের ত্যাগের কথা মনে রেখে আমাদেরও একটু ত্যাগ করতে হবে। এ বারের পুজোর তিন মহামন্ত্র হোক: বুদ্ধি, সাবধানতা ও সংযম। ভরসা থাকুক স্যানিটাইজার, মাস্ক, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ে। তাই এ বছর আমাদের মনে রাখতে হবে পুজোয় কিছুটা আনন্দের সঙ্গে চাই অনেকটা সংযম। আমরা আনন্দপ্রিয় হতে পারি, কিন্তু তা বলে অবিবেচক কেন হব? তাই তো সিঁদুরের ফাগ উড়বে না এবার। দশভুজার দশ হাত থেকে সিঁদুরের ঝর্ণা ঝরবে না। লালে লাল করে রক্তিম প্লাবনে ভাসিয়ে দেবে না সারা বছরের গৃহবন্দি শিল-নোড়া-হাতা-খুন্তির শেকল। তবু নবমীনিশি পেরিয়ে সেই কুচো নিমকির গন্ধটা যেন টিকে থাকে। মন খারাপ করা গন্ধটাই জানান দেয়, ‘আসছে বছর আবার হবে।’ আসছে বছরে বিশ্বাস রাখুন।
পৃথিবী সেরে উঠুক। করোনা ভাইরাস দূর হোক। সামনের বছর আবার আসবেন মা। ততক্ষণ পুজো হোক ঘরে-ঘরে। মনে-মনে। নিষ্ঠায়। ভক্তিতে। আরাধনায়। মহামারীর সঙ্কটের মধ্যে এই রঙবেরঙের আলোর রোশনাই যেন আশার আলো, কোভিড-১৯ পৃথিবী থেকে দূর হতে আর দেরি নেই। এ বছর হল না। সামনের বছর নিশ্চয়ই হবে দুর্গোৎসব, বাঙালির মিলনের উৎসব। রাংতায় ঝিকিয়ে ওঠা আলো আর ত্রিপলের গন্ধে মেদুর পুজোর ছবি ফিরে আসবে আবার। নিশ্চিত।
23rd October, 2020