মায়েদের ভালো রাখতে
অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের যথাযথ পুষ্টি না হলে সন্তানের বৃদ্ধিও ঠিকমতো হবে না। তাই এই অবস্থায় কী কী বিষয় খেয়াল রাখবেন, তা নিয়ে বিশদ জানালেন গাইনোকলজিস্ট অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়।
গোড়ায় কী করা উচিত, কী নয়
বাচ্চার জন্মের আগে থেকেই এখন মায়েদের ফলিক অ্যাসিড শুরু করে দিতে বলি আমরা। ফলিক অ্যাসিডের ডোজ হচ্ছে ৪০০ এমজি। সেটা পাওয়া যায় না বলে ৫ মিলিগ্রামের ট্যাবলেট দিই। এতে বাচ্চার ব্রেন আর স্পাইনাল কর্ডের ডিফেক্ট অনেক কম হয়। অতি সম্প্রতি বলা হচ্ছে, ডিএইচএ দিলে বাচ্চার ব্রেন প্রথম থেকেই খুব ভালো করে ডেভেলপ হয়। সঙ্গে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। শাকসব্জি, প্রোটিন জাতীয় খাবার, নানা ধরনের ফল ইত্যাদি তো আছেই। জাঙ্ক বা ফাস্ট ফুড যত এড়িয়ে চলা যায়, তত ভালো। রেডি টু ইট জাতীয় প্যাকেটের খাবারও না খাওয়াই উচিত। স্মোকিং একেবারেই নয়। একই নিয়ম অ্যালকোহলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এতে বেবির গঠন ভালো হয়। যেসব মায়েদের ওবেসিটি রয়েছে, সেটা আগে কমিয়ে ফেলতে পারলে ভালো হয়। কারও প্রেশার বেশি থাকলে অতিরিক্ত নুন খাবেন না। এ ধরনের যে কোনও জিনিস কন্ট্রোল করে আইডিয়াল সিচুয়েশনে গিয়ে প্রেগন্যান্সি প্ল্যান করলে ভালো। প্রথম তিন মাসে পুষ্টির দিকটা সেভাবে নজর দেওয়া যায় না। কারণ হবু মায়েদের তখন গা-বমি, মাথা ঘোরা এইসব লক্ষণ বেশি থাকে। ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ ওষুধটা তখন জরুরি। ওই সময় তেল-ঝাল কিছুটা কম রেখে যেটা ইচ্ছে, মায়েদের বলা হয় সেটাই খেতে।
কী কী খাবেন
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার হজম করা সহজ। তাই সেটা বেশি খেয়ে ফ্যাট জাতীয় খাবার কিছুটা কম খাওয়া ভালো। রোজ ১৮০০ কিলো ক্যালোরি যাতে মা পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ম্যালনিউট্রিশন হয়ে যায়। প্রতিদিন ৭০ গ্রাম প্রোটিন লাগবেই। যদি দেখা যায়, কোনও অন্তঃসত্ত্বা মহিলা নর্মাল খাবার খেতে পারছেন না, ১৫০০-১৮০০ কিলো ক্যালোরির কম খাচ্ছেন, তাহলে হরলিক্স বা ফুড সাপ্লিমেন্টস নিয়ে আমরা সেগুলো পরিপূর্ণ করতে পরামর্শ দিই। গর্ভাবস্থার ১২ সপ্তাহ পরে পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নত হয়। তখন খিদেও বাড়ে। আমরা বলি ভালোরকম খাওয়াদাওয়া করতে। ভারত সরকারের সুপারিশ মতো ১০০মিলিগ্রাম আয়রন প্রতিদিন দিতে বলা হয়। ক্যালসিয়াম দেওয়া হয় রোজ ১০০০-১৫০০ মিলিগ্রাম। সঙ্গে ফলিক অ্যাসিড আর ডিএইচএ যেমন চলে, চলবে। ওই সময় কারও যদি যমজ বাচ্চা থাকে, তাহলে আরও ৫০০ কিলো ক্যালোরি বেশি খেতে বলা হয়। কোনওরকম ডায়েটিং কিন্তু প্রেগন্যান্সির সময় না করাই ভালো। মডেলিং পেশায় রয়েছেন, এমন অনেকেই বলেন ‘আমার ডায়েটিং না হলে চলবে না।’ এটা কিন্তু খুব মারাত্মক। প্রেগন্যান্সিতে ১০ কিলো ওজন যদি না বাড়ে, তাহলে বাচ্চার ওজন আড়াই-তিন কেজি হবে না। বাচ্চা অপুষ্টির শিকার হবে। তবে কেউ চাইলে আমরা সেইভাবে ডায়েট করে দিই যাতে প্রোটিন বেশি, কার্বোহাইড্রেট একটু নিয়ন্ত্রিত, ফ্যাট কম। তাহলে কন্ট্রোলড পদ্ধতিতে ওজন বাড়ে। সঙ্গে পুরো প্রেগন্যান্সি জুড়ে আয়রন-ক্যালসিয়াম-ফলিক অ্যাসিড-ডিএইচএ সাপ্লিমেন্টস তো আছেই।
বাচ্চার জন্মের পরে যত্ন
বাচ্চা হওয়ার পরপরই মায়ের কিছুটা ওজন কমে যায় (৫-৬ কেজি)। কারণ বাচ্চার ওজন, জলের ওজন (৬ লিটার জল শরীরে থাকে) এগুলো সবই বেরিয়ে যায়। এটা শুনে অনেক মা আশ্বস্ত হন। কিন্তু আবার বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করানোর সময় কোনওরকম ডায়েটিং চলবে না। এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করালে ৫০০-৮০০ ক্যালোরি লস হয়। ওই সময়ে ক্যালসিয়ামও মাস্ট। দুধের সঙ্গে প্রচুর ক্যালসিয়াম বেরিয়ে যায়। মায়েদের হাড়গোড় নরম হয়ে যায়। ওই সময়েও ডিএইচএ খাওয়া ভালো। আর অ্যাডিশনাল ক্যালোরি (১৮০০-২২০০), যমজ বাচ্চার ক্ষেত্রে আর একটু বেশি লাগবে। তা না হলে অনেকটা ওজন কমে যেতে পারে। শেষে বলি, পুরো প্রেগন্যান্সি আর ল্যাকটেশন পিরিয়ডে পাঁচটা খাবার অবশ্যই লাগবে। তার মধ্যে রয়েছে, হাফ লিটার দুই-দই-ছানা, রোজ একটা আপেল ও একটা বেদানা, রোজ একটা মাছ ও একটা করে ডিম, পরিমাণমতো শাকসব্জি, আর সপ্তাহে দু’তিন দিন চিকেন ও মাটন। তবে চিকেন বা মাটনের লিভার এই সময় না খাওয়াই ভালো। এতে ভিটামিন এ থাকে, তার থেকে বাচ্চার হাইপার ভিটামিনোসিস হতে পারে। প্রচলিত একটা ধারণা আছে, আনারসে থাকা ব্রোমেলিন থেকে গর্ভপাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর পেঁপেতে পাপায়েন আছে, এটাও গর্ভপাতের কারণ হতে পারে। কিন্তু এগুলোর বিজ্ঞানসম্মত কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে অনেকদিন ধরে এটা বলা হয়ে আসছে, এবং হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদে এই ফল দু’টি গর্ভাবস্থায় না খাওয়ার কথা বলা হয়, বাড়ির বয়স্করাও এমন কথা বলে থাকেন। ব্রোমেলিন আর পাপায়েন ফিটাসের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এই প্রচলিত ধারণাকে ধরে নিয়ে চিকিৎসকেরাও প্রেগন্যান্সির সময় এই ফল দু’টি খেতে বারণই করেন।
05th September, 2020