সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
আশঙ্কা করছিলেন, হাসপাতালে হাসপাতালে সেই আশঙ্কায় বাড়তি বেড রাখার কথাও বলা হচ্ছিল। এসব দেখে মনে পড়ছিল অসমের জাটিঙ্গার কথা। অদ্ভুত রহস্যজনক এক গ্রাম। যেখানে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি বছরের একটা বিশেষ সময়ে উড়ে আসে আত্মহননের নেশায়। সেই আত্মহননের মধ্যে কী কোনও আনন্দ লুকিয়ে থাকে? গবেষকরা আজও সেই রহস্যের সন্ধান করে চলেছেন। হাইকোর্টের নির্দেশে আশা করি অতি উৎসাহীরা সংযত হবেন। এবারের উৎসবকে শেষ পর্যন্ত জাটিঙ্গার মতো আত্মহত্যার উৎসব হতে দেব না, সেই প্রতিজ্ঞা আমাদের সবাইকে করতে হবে।
আমাদের বোঝা উচিত, করোনা নিঃশব্দে গেরিলার মতো ঘাপটি মেরে বসে আছে। এবার উৎসবের প্রাঙ্গণজুড়ে মৃত্যুর আলপনা। একটু বেচাল অবস্থা হলেই ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যাবে করোনার সংক্রমণ বিপ্লব। যে ভাইরাসকে আমরা তিল তিল করে
নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছি, সারা বিশ্ব যে রোগের
ওষুধ আবিষ্কারের জন্য মাথা কুটছে, তাকে আমরা উদ্দাম জমায়েতের মধ্য দিয়ে ওয়াকওভার পেতে দেব না। আর কয়েকটা মাস হয়তো আমাদের এভাবে চোয়াল চেপে এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত যেন তীরে এসে তরী না ডোবে। এই সচেতনতাটুকু কী আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না? পুজোর শেষে বিসর্জনের সময় আমরা যেমন বলি, ‘আসছে বছর আবার হবে।’ সেটাই এবার আমরা পুজোর আগেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধভাবে বলি, ‘আসছে বছর বড় করে হবে।’ আসছে বছরে সেরার সেরা থিমের পুরস্কার আমরাই জিতব। আসছে বছর সেরা ইঁদুর বা সেরা পেঁচার পুরস্কার আমাদের জিততেই হবে।
এবার বৃহত্তর স্বার্থে সব দূরে থাক। পুজোটুকু হোক। সেখানে আমাদের অন্তরের স্পর্শটুকু লেগে থাকুক। এবার শুধু পুজো হোক, লকডাউন থাকুক উৎসবের লাগামছাড়া বহিঃপ্রকাশে।
সকাল দেখেই যেমন বোঝা যায়, দিনটা কেমন যাবে, তেমনই বাঙালির আত্মঘাতী স্বরূপে পুজোর বাজার দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এবার শারদোৎসব কেমন যাবে। আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর উদাহরণ হয়ে আছে ওনাম উৎসব। আমরা সবাই জানি কেমন করে ওনামের পর কেরলে বেড়ে গেল করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। শুধু পুজোর বাজারকেই বা দোষ দিই কী করে! সিপিএমের আন্দোলন আর বিজেপির নবান্ন অভিযান কম যায় কীসে? বিজেপির ওই অভিযান তো তবলিগি সমাবেশের আতঙ্ককেও হার মানিয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে বিজেপির সাম্প্রতিক অভিযানের নিট ফল নেগেটিভ হলেও নিঃশব্দে করোনা সম্প্রসারণে সেটি পজিটিভ ভূমিকা নিয়েছে বলে অনুযোগ করাই যায়। তাই সমস্ত পরিস্থিতি বিচার করে হাইকোর্টের এই রায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করা যায়, ওই রায় আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তিকে অনেকটাই বাড়িয়ে দেবে। সেই সঙ্গে বলতে হয়, পুজোর আবহাওয়া নিয়ে পূর্বাভাসের কথা। আবহাওয়া দপ্তর পুজোর মধ্যে বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা ঘোষণা করেছে। বৃষ্টি হলে এবার সেটা শাপে বর হয়ে যাবে। বলা যেতে পারে, হাইকোর্টের রায় এবং বৃষ্টির পূর্বাভাস, এমন রাজযোটকের আশীর্বাদে বাইরে বেরনোর উৎসাহ অনেকটাই কমতে পারে।
কিন্তু কোর্টের রায় কি সব? বাঙালি আবার একটু ভাবুক জাত। সেই সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তাই সে অন্যরকম ভাবে। হাইকোর্টের রায়ে ‘নো এন্ট্রি’ তো মণ্ডপে। রাস্তায় তো নয়, সুতরাং পথ জুড়ে উৎসবে ভেসে বেড়ানোর লাগামছাড়া আচরণ লক্ষ্য করা যেতেও পারে। এগরোল, বিরিয়ানি, আইসক্রিম কিংবা ফুচকার মস্তি কি আর থাকবে না! লকডাউনে যাঁদের ঘরে আটকে রাখা যায়নি, থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে যাঁরা ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে’ বলে পাড়া বিজয়ে বেরিয়েছিলেন, পুলিসের সামনে কান ধরে ওঠবস করেও যাঁরা অসম্মানকে জয় করতে পেরেছিলেন, করোনা নিয়ে বড় বড় লেকচার দিয়েছিলেন, কিংবা পাড়ার মোড়ে চা খেতে গিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন এবং পুজোর আগে বাজারে গিয়ে সব স্বাস্থ্যবিধি জলাঞ্জলি দিয়ে দেদার কেনাকাটা করেছেন, তাঁদের ঘরে আটকে রাখবে কোন আদালতের রায়! বেরিয়ে তাঁরা পড়বেনই। মণ্ডপ ফাঁকা থাকলেও রাস্তায় যে মানুষের ঢল নামবে না, তার গ্যারান্টি বাঙালি দিতে পারছে না। কিন্তু এবার আমাদের সামনে কঠিন পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় আমাদের জয়ী হতেই হবে। তাই এবারের পুজো হোক অন্য পরিবেশে, অন্য মানসিকতায়। বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে একটু আড্ডা, খাওয়া দাওয়া এবং টিভিতেই হোক ঠাকুরদেখা। এছাড়া আমরা করোনার অমিতবিক্রমকে রোধ করতে পারব না। যেভাবে দেবী দুর্গা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন, সেভাবেই আমাদের ভার্চুয়াল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পজিটিভ হওয়া থেকে বাঁচতে হবে। করোনা যেন রক্তবীজের দল। তাকে নিঃশেষ করার জন্য দেবীর আশীর্বাদ আমাদের কাম্য। আমরা দেবীর কাছে প্রার্থনা করে শাক্তগীতিকার দ্বিজ শম্ভুচন্দ্রের মতোই বলতে পারি, ‘কুদিন ঘুচে’ সুদিন কি আর হবে না!’ হবে, নিশ্চয়ই হবে। সেই সুদিনের প্রত্যাশাই ঘিরে থাকুক আমাদের।
তাই আজ যখন কার্তিকের ‘শারদপ্রাতে বেজে উঠছে আলোক মঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাব মাধুরীর সঞ্জীবন। ’ তখন যেন আমরা সেই উৎসবে সংক্রমণের বিরুদ্ধে সেই সঞ্জীবনকেই প্রকাশিত হতে দেখি। দেবী দুর্গার মধ্যে যে ব্যপ্ত তেজরাশির প্রকাশ, তা সেই সঞ্জীবনেরই প্রকাশমাত্র। সেই সঞ্জীবনসুধা আমাদের অমৃত দান করে। তিনি দুর্গা। তিনি শক্তির আধার। তিনি অদ্বিতীয় চৈতন্যরূপিণী। কিন্তু কেন তিনি দুর্গা? চণ্ডীতে আছে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করার পর দেবতাদের বরদানের সময় দেবী দুর্গা বলেছিলেন, ত্রিলোকে অসুররা যখনই উৎপাত করবে, তখনই আমি আবির্ভূত হব এবং সেই বিপদ থেকে সকলকে উদ্ধার করব। আর দুর্গম নামে এক অসুরকে বধ করে আমি দুর্গা নামে খ্যাত হব। প্রাচীনকালে রুরু অসুরের পুত্র দুর্গমাসুর কঠোর তপস্যায় ব্রহ্মার কাছ থেকে অজেয়ত্ব এবং কোনও পুরুষের হাতে নিহত না হওয়ার বর লাভ করেন। এই বরে মত্ত হয়ে দুর্গমাসুর দেবতাদের স্বর্গচ্যূত করেন। দেবতারা শিবের শরণাপন্ন হন। দুর্গমাসুর ছিলেন মহা বলবান। মায়াবী অসুর দেবীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় মায়াঝড় সৃষ্টি করে আকাশপথে যুদ্ধ করতে থাকেন। নানারূপ ধারণ করে দুর্গমাসুর দেবীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে লাগলেন। একবার করে দেবী তাঁকে আঘাত করেন আর ক্ষণে ক্ষণে দুর্গমাসুর রূপ বদল করতে থাকেন। অবশেষে দেবী দুর্গমাসুরকে বধ করলেন। দেবী বললেন, ‘অদ্য প্রভৃতি মে নাম দুর্গেতি খ্যাতিমেষ্যাতি।’ আজ থেকে আমার নাম দুর্গা বলে খ্যাত হবে। তিনি আরও বললেন, ‘ন তেষাং দুর্গতিঃ ক্কচিৎ।’ যে দুর্গার শরণ নেবে, তার কখনও দুর্গতি হবে না। দেবী দুর্গা তাই দুর্গতিনাশিনী। আজ এই অতিমারীর কালে তাঁকে আহ্বানের মধ্য দিয়ে, পুজোর মধ্য দিয়ে আমরা যেন চৈতন্যলাভ করি। যে প্রাজ্ঞচৈতন্যের মধ্য দিয়ে এই জগৎকে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়, এই জগৎকে ভালোবাসার আধার করে গড়ে তোলা যায়। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমোনমঃ।’ তিনি হলেন চৈতন্যের আধার। তাঁর অসীম চৈতন্যের দীপ্তির কণিকা স্পর্শ করুক আমাদের। সেই চৈতন্যই হোক দেবীপূজার প্রকৃত প্রসাদ।