সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
বৈদিক যুগে শক্তির আরাধনার বীজ যে কতখানি পুষ্পিত হয়েছিল উপরিউক্ত এই সুস্পষ্ট ছবিটি পাওয়া গেল সামবেদীয় উপনিষদে। এখানে ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী বহুশোভমানা দেবী উমা-হৈমবতীর দর্শন পাই। ইনিই দেবরাজ ইন্দ্রকে ব্রহ্মজ্ঞান দিয়েছিলেন। সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতা থেকে উৎসারিত হয়েছিল শক্তি আরাধনার মূল ধারাটি। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা’ এই অখণ্ড মহতী শক্তি ভক্তজনকে অনুগ্রহ করার নিমিত্ত মহামাতৃকায় বিভিন্ন রূপ ধারণ করে প্রকাশিত হন। —‘সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা’। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, অন্নপূর্ণা, গায়ত্রী, সাবিত্রী, চামুণ্ডা, চণ্ডী প্রভৃতি নাম ও মূর্তি মাতৃপুজোর এক বিশেষ অভিব্যক্তি। জগন্নিয়ন্ত্রী আদ্যাশক্তি মহামায়া শারদ লগ্নে আমাদের সমক্ষে পুজোর বেদিতে আবির্ভূতা হন মহাশক্তি দারিদ্র্য দুঃখহারিণী জগন্মাতা মা দুর্গারূপে। তিনিই আমাদের সকলের জননী জগৎপালিনী দুর্গতিহারিণী দুর্গা। জগতের সমস্ত দুঃখকে দূর করে যিনি মানবকে আনন্দময় করে তোলেন তিনিই মা দুর্গা।
পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদে মাঙ্গল্যদায়িনী মহাজননীর সর্বদেবময়ী ঈশ্বরীরূপের সর্বাগ্রে পরিচয় পাই। এখানে দেবী অদিতিরূপে চিহ্নিত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ‘দেবী সূক্তে’ দেবী নিজেকে সর্বশক্তি সমন্বিতা, সর্বস্রষ্টী, জগতের ঈশ্বরী বলে আভাসিত করেছেন। শুক্ল যজুর্বেদে দেবী অম্বিকা শারদা নামেই ধরা দিয়েছেন। তাই এই শরৎকালই যেন মা অম্বিকার এক শোভন ও রমণীয় রূপ। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের মহানারায়ণ উপনিষদে পাই, ‘দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে।’—আমি দেবী দুর্গার আশ্রয় গ্রহণ করি। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দুর্গা গায়ত্রীতে উল্লেখ দেখা যায়, ‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারীং ধীমহি তন্মো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।’ এই মন্ত্র শ্রীদুর্গাগায়ত্রী রূপেই বন্দিত। সায়নাচার্যের ভাষ্যমতে দুর্গি ও দুর্গা অভিন্ন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী পুজোর সামগ্রিক বিকাশটি সুস্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। আদ্যাশক্তি মহামায়া গুণ ও কর্মভেদে তিনি কখনও মহাকালী, কখনও মহালক্ষ্মী, কখনও বা মহাসরস্বতী রূপে প্রকাশিতা। তামসীরূপে তিনি মহাকালী, সাত্ত্বিকীরূপে তিনি মহাসরস্বতী আর বাজসীরূপে দেবীর প্রকাশ মহালক্ষ্মীরূপে। চণ্ডীতে দেবী নিজেই তাঁর পরিচয় দিয়ে বলেছেন, ‘আমি আবার দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করে, দুর্গাদেবী নামে বিখ্যাত হব।’
দেবী ভগবতী চণ্ডিকাদেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর বৈচিত্র্যময় স্বরূপটি প্রকটিত। যে চণ্ডিকা মধুকৈটভাদি দৈত্যদলনকারিণী, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী, যিনি ধূম্রলোচন-চণ্ডমুণ্ডাসুরসংহারিণী, যিনি রক্তবীজ- ভক্ষয়িত্রী, যে শক্তি শুম্ভনিশুম্ভাসুর- বিনাশকারিণী এবং পরমা সিদ্ধিদাত্রী এবং নবকোটি সহচরী পরিবৃতা সেই বিশ্বেশ্বরীদেবী আমাকে পালন করুন। ‘যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী’ ইত্যাদি।
‘জগন্মাতা দুর্গা হতে অভিন্না নব মাতৃকা শক্তি সমষ্টিগত ভাবে নবদুর্গা নামে বিশেষ প্রসিদ্ধ। শ্রীশ্রীচণ্ডীর ‘দেবীকবচ’ স্তোত্রে দেবী দুর্গার নয়টি নাম উল্লিখিত। যথা শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, দেবী দুর্গার এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছেন। ‘দুর্গাসি দুর্গ ভবসাগর নৌর সঙ্গা’— দুর্গ বা সঙ্কট হতে যিনি সকলকে উদ্ধার করেন, তিনিই দুর্গা। মাতৃপুজোর ইতিহাস অনুধ্যান করলে আমরা দেখতে পাই সর্বমঙ্গলা এই চিন্ময়ী ভগবতী স্বর্গের অমরগণ, মর্ত্যের রাজন্যবর্গ ও দেশনায়কদের অনিষ্ট নাশনে যুগে যুগে অসুরশক্তিকে বিধ্বংস করে বিশ্ব চরাচরে উদ্ধারকর্ত্রী রূপে পূজিতা ও বন্দিতা হয়েছেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আছে, মেধাঋষির নিকট দেবী মাহাত্ম্য বিস্তারিতভাবে শোনার পর রাজ্যহৃত রাজা সুরথ এবং স্বজন পরিত্যক্ত সমাধি বৈশ্য নদীতটে মাতৃদুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নির্মাণ করে পুষ্পধূপাগ্নি তর্পণ দ্বারা দেবীর পুজো করেছিলেন। মা দুর্গার বর পেয়ে নৃপতি সুরথ ফিরে পেয়েছিলেন রাজ্যপাট আর মুমুক্ষু সাধক সমাধি হয়েছিলেন মুক্তিপদ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী। রাজা সুরথ বসন্তকালে মৃন্ময়ী প্রতিমাতে দুর্গা-অর্চনা করেছিলেন বলে তাই এই পুজোর নাম বাসন্তী পুজো। ত্রেতাযুগে মর্যাদা-পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র সীতা উদ্ধার কামনায় শরৎকালে অকালে দেবীর বোধন করে যে পুজো করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা আজও চলে আসছে। তখন থেকেই এই শারদীয়া দুর্গাপুজোর প্রচলন বলে কথিত। বাংলার মহাকবি কৃত্তিবাসের রামায়ণে একশো আট নীলপদ্ম দ্বারা শ্রীরামের দুর্গোৎসবের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে। মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণে রামচন্দ্রের দুর্গাবন্দনার কথা উল্লেখ না থাকলেও দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ, বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ, মহাভাগবত পুরাণাদিতে দুর্গাদেবীর অকালবোধনের নানান প্রকারের কথা দৃপ্ত কণ্ঠে বিঘোষিত। ‘রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ’। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চিরশুভকারিণী দেবী দুর্গা প্রথম প্রকৃতিরূপে বর্ণিত। সৃষ্টির কার্যে প্রকৃতি পাঁচভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে তিনি গণেশজননী দুর্গা, দ্বিতীয় হলেন মহালক্ষ্মী, তৃতীয় সরস্বতী, চতুর্থ রাধা ও পঞ্চম সাবিত্রীরূপে।
ভারতের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার প্রথম রূপকার পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাস্তুতির কথা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আলোচিত। এই মহাপুরাণের প্রকৃতিখণ্ডের ৬৬তম অধ্যায়ে আছে, রাসেশ্বর রাধারমণ যশোদাদুলাল, বৃন্দাবনের রাসমণ্ডলে প্রথম মহামায়া মহাজননীর অর্চনা করেছিলেন। ‘প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা। বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদৌ গোলকে রাস মণ্ডলে।’ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এই প্রকৃতিদেবী দুর্গাশক্তি সম্বন্ধে দেবকীনন্দন গোপরাজ নন্দকে বলেছিলেন, ‘শ্রীদুর্গা আদিভূতা নারায়ণী শক্তি। আমার এই শক্তি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কারিণী। আমার ওই শক্তি হতেই এ সংসারের উৎপত্তি। ইনিই গোলকে রাধিকা, বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী, কৈলাসে সতী এবং হিমালয়ে পার্বতী। ইনিই আবার সরস্বতী ও সাবিত্রী। বহ্নিতে দাহিকা শক্তি, ভাস্করের প্রজা শক্তি, চন্দ্রে শোভা শক্তি, ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণ্য শক্তি, দেবগণে দেব শক্তি, তপস্বীতে তপস্যা শক্তি—সকলই ইনি। আমার ওই শক্তি গৃহীগণের গৃহদেবতা, মুক্তের বিদ্যারূপা এবং সাংসারিকের মায়া। আমার ভক্তগণের মধ্যে ইনিই ভক্তিদেবী রূপে বিরাজিতা। রাজার রাজলক্ষ্মী, বণিকের লভ্যরূপা, শাস্ত্রে ব্যাখ্যারূপিণী, সাধুগণের সুবুদ্ধিরূপা, মেধাবীতে মেধাস্বরূপা, দাতৃগণের দানরূপা—সকলই ওই শক্তি। এককথায় দুর্গাশক্তি সর্বশক্তিস্বরূপা।’
লেখক প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থপ্রণেতা