সব কর্মেই অর্থকড়ি উপার্জন বাড়বে। কর্মের পরিবেশে জটিলতা। মানসিক উত্তেজনা কমাতে চেষ্টা করুন। ... বিশদ
নাকাশিপাড়া বাজারে কাঠফাটা রোদের মধ্যে রঙিন ছাতা খাটিয়ে শসা বিক্রি করছিলেন রঘুনাথ সরকার। রোদের তাপের মধ্যেও শসা সতেজ রাখার জন্য দিচ্ছিলেন জলের ছিটে। ভোটের হাওয়া জানতে চাওয়ায় রঘুনাথবাবুর উত্তর, ‘এবার লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। তবে পাল্লা ভারী বিজেপির।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রসেনজিৎ সরকারের প্রতিবাদ, ‘মোটেই না। দিদির হাওয়া। দেখবেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বিরোধীদের পাল্লা হাল্কা করে দেবে।’
রায়গঞ্জের রাজবাড়ি গেটের কাছে রয়েছে দিলদার হোসেনের সাইবার কাফে। সেখানে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা তুলতে এসেছিলেন শঙ্করপুর গ্রামের করুণা দেবশর্মা বর্মণ। অভাবের সংসার। তাই নিজে সেলাইয়ের কাজ করেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রসঙ্গ তুলতেই একমুখ হাসি। বললেন, ‘এই টাকাটা হয়তো অনেকের কাছেই সামান্য। কিন্তু আমাদের জন্য অনেক। খুব উপকার হয়েছে।’
যশোদা সর্দারের বাড়ি বেলডাঙার সারগাছিতে। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। বহরমপুর শহরে ঘরভাড়া নিয়ে থাকেন। চারটি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে মাসে পান সাড়ে তিন হাজার টাকা। সংসার চালাতেই সব শেষ। অসুখ করলে হাত পাততে হতো।
তবে, এখন আর হাত পাততে হয় না। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কিছু টাকা খরচ করেন, বাকিটা রাখেন অসময়ের জন্য। তাঁর কথায়, ‘এতদিন সবাই ভোট নিয়েছে, কিন্তু আমাদের কথা কেউ ভাবেনি। দিদিই প্রথম আমাদের কথা ভেবেছে। তাই আমরাও আছি দিদির পাশে। ’
দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ, সর্বত্রই ভোটচর্চার মুখ্য বিষয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি সব দলের নেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে এই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। একান্ত আলাপচারিতায় প্রায় সব নেতাই মানছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মোকাবিলাই এবারের নির্বাচনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ব্যতিক্রম বিজেপির দিলীপ ঘোষ।
দিলীপবাবু এখনও তাঁর আগের মন্তব্যে অনড়। এখনও তাঁর দাবি, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে মহিলাদের তৃণমূল শুধু ভিখারি বানায়নি, আরও নীচে নামিয়েছে। সন্দেশখালি তার প্রমাণ। উত্তরবঙ্গের বিজেপি নেত্রীর মতো ক্ষমতায় ফিরলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেননি দিলীপবাবু। তবে, এই প্রকল্প চালু রাখা নিয়ে তাঁর ঘোর সংশয় রয়েছে। তাঁর কথায়, বিজেপি সর্বভারতীয় দল। সেই দল কোনও একটি রাজ্যের জন্য এই প্রকল্প চালু রাখতে পারে না। সেটা করলে সব রাজ্যেই করতে হবে। ভোটের আগে অনেকে অনেক কথা বলতেই পারে। কিন্তু আমি সেই নীতিতে বিশ্বাসী নই।
এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মোকাবিলার কোনও অস্ত্র বিরোধীদের হাতে নেই। অনেকেই মনে করছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারই প্রধান প্রতিপক্ষ। তাই অনেক বিজেপি নেতা মহিলাদের মাসে দু’হাজার, তিন হাজার টাকা দেওয়ার ‘গাজর’ ঝোলাচ্ছেন। কিন্তু দিলীপ ঘোষের মুখে এখনও উল্টো কথা।
লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের বিরোধিতা করলে ভোট কমার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু দিলীপবাবু নিজের স্ট্যান্ডে অটল। অন্য বিজেপি নেতাদের সঙ্গে দিলীপ ঘোষের ফারাকটা এখানেই। তিনি যেটা সত্যি বলে মনে করেন সেটাই বলেন। দিলীপবাবু প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় এলে বন্ধ হবে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’।
বাম আমলে একটা পলিথিন দেওয়ার আগেও যাচাই করা হতো বেনিফিসিয়ারির রাজনৈতিক পরিচয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছেন। এখন সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্য পার্টি অফিসের সুপারিশের প্রয়োজন হয় না। কাগজপত্র ঠিক থাকলেই মেলে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা। এমনকী, কোনও মানুষ সরকারি পরিষেবার বাইরে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারি কর্মীরা গ্রামে গ্রামে ঘোরেন। তাই রেখা পাত্রের মতো কট্টর বিজেপি কিংবা সিপিএম পরিবারের মা, বোনেদেরও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেতে অসুবিধা হয় না। দলমত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষ বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পায়। এটাই উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত। ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’।
সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেলেই তিনি শাসক দলের অনুগামী হয়ে যাবেন, এমনটা নয়। বিশেষ করে সক্রিয়ভাবে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা নিজের দলকেই সমর্থন করবেন। সরকার যত কাজই করুক, আর যত সুবিধাই দিক তাঁদের মত পাল্টায় না। উল্টে খুঁত বের করেন। তবে পরিষেবা ও সুযোগ সুবিধার বিচারে বদলায় ‘ফ্লোটিং ভোটারে’র অভিমুখ। এই ফ্লোটিং ভোটাররা কোনও রাজনৈতিক দলের ‘গোলাম’ হন না। তাঁরা মিটিং, মিছিলে যান না। তাঁরা মূলত সরকারের কাজ ও ব্যক্তিগত সুবিধা, অসুবিধার কথা মাথায় রেখে ভোট দেন। তাঁরাই সরকারকে স্থায়িত্ব দেন এবং ‘পরিবর্তনে’ও নেন অগ্রণী ভূমিকা। অনেকেই বলছেন, এবার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ফ্লোটিং মহিলা ভোটারের অভিমুখ ঠিক করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
একুশের নির্বাচনেই প্রমাণ হয়েছে, বাংলায় মহিলা ভোটারদের উপর বিজেপির প্রভাব তেমন নেই। কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মা, বোনেদের মনে আস্থার বীজ বুনেছিলেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার তাকে মহীরুহে পরিণত করেছে। তার শিকড় পৌঁছেছে মাটির অনেক গভীরে। তাকে ধরাশায়ী করা সহজ কাজ নয়।
মালদহের এক বিজেপি নেতার কথায়, জেলার দু’টি আসনেই আমাদের অনুকূল পরিস্থিতি। মালদহ উত্তরে আমরা আগে থেকেই শক্তিশালী। আর দক্ষিণে কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট কাটাকাটিতে আমাদের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাছাড়া তৃণমূলের দ্বন্দ্ব ও দুর্নীতি দেখে মানুষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তবুও আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। কারণ একটাই, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।
পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের এক তৃতীয়াংশ লোকসভা আসনে পুরুষের চেয়ে মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি। বাকি আসনে প্রায় সমান সমান। উত্তরবঙ্গ সহ রাজ্যের ১২টি লোকসভা কেন্দ্র ঘুরে মনে হয়েছে, পাড়ার আড্ডায় বা চায়ের ঠেকের আলোচনা থেকে এবারের ভোটের অঙ্ক কষা কঠিন। কারণ গ্রামে, গঞ্জে বইছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের প্রবল হাওয়া। সেই হাওয়ায় উল্টে যাবে বহু আসনে ভোটের অঙ্ক।
একুশের ভোটের বদলা নিতে বিজেপি সহ বিরোধীরা গত তিন বছরে একের পর এক ইস্যুকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দিয়ে তৃণমূলকে নাস্তানাবুদ করেছে। কিন্তু লাভ তেমন হয়নি। শাসক দলের বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রীকে জেলে ভরলেও বদলায়নি পরিস্থিতি। ফায়দা আসেনি সন্দেশখালি কাণ্ডেও। বিজেপির শেষ অস্ত্র ছিল সিএএ। সেটাও ব্যুমেরাং হয়ে ফিরছে। বিরোধীদের ইস্যুর নবতম সংযোজন ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি খারিজ।
আদালতের রায়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল বিরোধী শিবির। ভেবেছিল, ‘ঢাকি সহ বিসর্জনে’র ফায়দা পাবে তারাই। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে ততই সামনে আসছে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের চাকরি খোয়ানোর খবর। তাতে পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা বিরোধী শিবিরে। সেই ভয়ে কেউ কেউ সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। চোখের জলও ফেলছেন। কিন্তু চাকরি যাওয়ায় তাঁরা বেজায় খুশিই হয়েছেন। তাই এবার বিজেপি বিধায়ক অমর শাখার টার্গেট, ৫৯ হাজার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সহ বিভিন্ন প্রকল্প চালু করে ভাতের জোগান সুনিশ্চিত করতে চাইছেন, তখন বিরোধীরা মানুষের পেটে লাথি মারতে মরিয়া। সে ১০০ দিনের কাজের শ্রমিকই হোক বা শিক্ষক।