বৈদিক স্তোত্র দিয়েই শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। চারজন সন্ন্যাসী এবং কয়েকজন ভক্ত সমবেত কণ্ঠে বৈদিক স্তোত্র পরিবেশন করলেন। বৈদিক স্তোত্রের পর একখানি ভক্তিমূলক গান পরিবেশনে করলেন আসাম, আমিনগাঁও আশ্রম থেকে আগত নবীন সন্ন্যাসী স্বামী রামানন্দ এবং স্বামী গঙ্গানন্দ মহারাজ। গান শেষে বেদান্তের উপর একটি মনোজ্ঞ ভাষণ দিলেন শ্রীঅমিতাভ রায়। তিনি বললেন: ‘আমাদের ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ। বেদ কথার অর্থ জ্ঞান। বেদের এক নাম শ্রুতি। আমাদের মুনিঋষিরা সাধনালব্ধ যে অপৌরষেয়বাণী শ্রবণ করেছিলেন তাই পুরুষানুক্রমে শ্রুত হয়ে আসছিল। বেদব্যাস এই বাণীকে লিপিবদ্ধ করেন। এটাই বেদ। বেদের ছন্দ-ভাব দুরূহ। বেদের সার বা নির্যাস বেদান্ত। বেদান্ত ব্রহ্মের কথা বলে, ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, বস্তুমাত্রই ব্রহ্ম। জগতে যা কিছু দেখি সবই ব্রহ্ম। সকলের মধ্যেই সেই একই ঈশ্বরীয় সত্তা, একই শক্তি বিদ্যমান। সেই ঈশ্বরীয় সত্তাকে উপলব্ধি করার কথাই বলে বেদান্ত। এই দুরূহ জ্ঞান লাভের একমাত্র উপায় সদ্গুরু সংস্রয়। সদ্গুরু অর্থাৎ যিনি আত্মাজ্ঞান লাভ করেছেন। যিনি স্বরূপ উপলব্ধি করেছেন। একমাত্র তিনিই পারেন বেদান্তের সম্যক ব্যাখ্যা দিতে। তেমনি একজন ব্রহ্মজ্ঞানী মহাপুরুষ আছেন আমাদের বিরাটীতে যিনি দীর্ঘ একুশ বছর যাবৎ পাগলের মতো সর্বসাধারণের কাছে বেদান্ত বলে চলেছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের কাছে। আপনারা বিরাটী মায়ের বাড়িতে আসুন, এই মহাপুরুষের পুতঃসান্নিধ্যলাভ করুন এবং বেদান্ত আলোচনা শ্রবণ করুন। মনে রাখবেন যুগে যুগে যুগের প্রয়োজনের মহাপুরুষদের আবির্ভাব হয় লোকশিক্ষা এবং যুগধর্ম রক্ষার্থে লোকচক্ষুর অন্তরালে।’
অমিতাভ রায়ের ভাষণের পর বেনারস থেকে আগত রাহুল মুখার্জী ওডিসি নৃত্য পরিবেশন করলেন তিন পর্যায়ে রাহুলের যেমন কার্ত্তিকের মতো চেহারা তেমনি নিখুঁত মুদ্রা, দেহভঙ্গিতে পরিবেশিত নৃত্য দর্শকেরা আকণ্ঠ উপভোগ করলেন। এরপর কিন্নরকণ্ঠি শ্রীমতি গায়েত্রী চ্যাটার্জী গানে এবং বক্তৃতায় দর্শকদের মন জয় করলেন। এ ছাড়াও কয়েকজন ভক্ত বেদান্তের উপর মনোজ্ঞ ভাষণ দিলেন। সব শেষে ভগবানের ভাষণ শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহিত হয়ে শ্রবণ করলেন। তিনি যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়—“মানুষই ভগবান। মানুষকে ভালবাসলেই ঈশ্বরকে ভালবাসা হয়। পরমাত্মাটা কোথায়? পরমাত্মা তো কোন আকাশে নেই। ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।’ এই ব্রহ্মকে জানলে কী লাভ হয়? ‘ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিঃ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ’। সর্বসংশয় ছিন্ন হয়ে সর্ব কামাপ্তি লাভ হবে। সমস্ত কামনা-বাসনা শেষ হয়ে যাবে- আত্মজ্ঞান লাভ হলে। ব্রহ্ম কিংবা আত্মা দূরে নয়। তোমার ভিতরেই তাঁর অবস্থিতি। ধ্যান-সমাধির মাধ্যমেই তাঁকে জানা যায়। ঠাকুর বলেছেন— ‘ঈশ্বরদর্শনই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।’ আর তাতেই তোমার হৃদয়ের গ্রন্থি খুলে যাবে।
অমূল্য রতন বৈরাগীর ‘ভগবান-সান্নিধ্যে’ (১ম খণ্ড) থেকে