মহর্ষি পতঞ্জলিকৃত যোগসূত্র রাজযোগ নামে সুপরিচিত। ইহা যোগশাস্ত্রের প্রধান প্রামাণিক গ্রন্থ। এই শাস্ত্রের মূল উপনিষৎ। মানুষের সকল দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি এবং শাশ্বত শান্তি লাভের কার্যকর উপায় শিক্ষাদান এই যোগের উদ্দেশ্য। ইহা কোন ধর্মমত বা ধর্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর না করিয়া প্রত্যক্ষানুভূতির দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষানুভূত না হওয়া পর্যন্ত সকলের পক্ষেই ‘ধর্ম’ একটি অর্থহীন শব্দমাত্র। রাজযোগ এরূপ ফলপ্রদ যে, কোন ধর্মে বিশ্বাস না থাকিলেও কেবল এই যোগের সাধনগুলি অভ্যাস করিলে মানুষ সকল বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে। অনেকের মতে যোগদর্শন সাংখ্যমতের সাধনকাণ্ড। কারণ, সাংখ্যে সাধনের কথা নাই এবং সাংখ্যের পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব যোগদর্শনে স্বীকৃত। কেবল ঈশ্বরাদি কয়েকটি বিষয়ে উভয়ের মধ্যে প্রভেদ আছে। পতঞ্জলি এই পরিদৃশ্যমান স্থূল জগতের কারণরূপে এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বাহ্য জগতের শক্তিসমূহ অন্তর্জগতের শক্তির বহিঃপ্রকাশমাত্র। অন্তর্জগৎকে বশীভূত করিতে পারিলে বাহ্য জগৎকে বশীভূত করা সহজ। ইহার একমাত্র উপায়—মনকে সম্পূর্ণ বশীভূত করা। কারণ, মনই সূক্ষ্ম জগৎ ও স্থূল জগৎ অনুভবের একমাত্র অবলম্বন। মনের সাহায্যেই সকল অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রিয় কার্য করে। মন সংযুক্ত না হইলে অন্তরিন্দ্রিয় বা বহিরিন্দ্রিয়ের ক্রিয়া সম্ভব হয় না। এইজন্য মহর্ষি পতঞ্জলি শারীরিক ও মানসিক কতকগুলি যৌগিক ক্রিয়া সহায়ে মনকে সম্পূর্ণ বশীভূত করিয়া বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতের উপর আধিপত্য লাভের উপায় শিক্ষা দিয়াছেন। তাঁহার মতে মনের উপর সম্পূর্ণ আধিপত্য স্থাপনই কৈবল্যলাভের একমাত্র উপায়। মনকে বশীভূত করিতে না পারিলে কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান কোন সাধনই সম্ভব নয়। এই কারণে সকল সাধকের পক্ষেই মনকে বশীভূত করিবার উপায়রূপে সাক্ষাৎ বা পরোক্ষভাবে যোগের কোন-না-কোন প্রণালী অবলম্বন অপরিহার্য।
মনের উপর প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য পতঞ্জলি মনের বৃত্তিগুলিকে বিরুদ্ধ করিতে উপদেশ দিয়াছেন। তাঁহার মতে “চিত্তের বৃত্তিসমূহের নিরোধই যোগ।” ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়মাত্রেরই সম্পর্কে আসিলে চিত্তের যে পরিণাম হয় উহাকে চিত্তবৃত্তি বলে। মানুষের মন অসংখ্য বিষয়ের সম্পর্কে আসে বলিয়া উহার বৃত্তিও সংখ্যাতীত। মনের সকল বৃত্তি নিরুদ্ধ করিয়া মনকে বশীভূত করাই যোগের লক্ষ্য। মানুষের মনের ক্ষিপ্ত মূঢ় বিক্ষিপ্ত একাগ্র ও নিরুদ্ধ এই পাঁচ প্রকার অবস্থা। মন যখন কোন বিষয় স্থির না থাকিয়া অবিরত বিষয় হইতে বিষয়ান্তরে ধাবিত হয় তখন উহা ক্ষিপ্ত কাম-ক্রোধ-লোভাদি রিপু এবং নিদ্রা-তন্দ্রা-আলস্যাদি তমোগুণ বশীভূত হইলে উহা মূঢ়, ক্ষণিক স্থিরতার মধ্যেও নানাবিষয়ে ধাবিত হইলে উহা বিক্ষিপ্ত, যখন মন কোন এক বাহ্য বা আভ্যন্তর বিষয় আশ্রয়ে নিবাত নিশ্চল ও নিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় স্থির হয় তখন উহা একাগ্র এবং একাগ্র মন একেবারে বিষয়াবলম্বন-শূন্য হইলে উহাকে নিরুদ্ধ বলা হয়। সাধারণ নরনারীর মন ক্ষিপ্ত মূঢ় অথবা বিক্ষিপ্ত। এই ত্রিবিধ অবস্থাপন্ন মনকে অষ্টাঙ্গ সাধন দ্বারা ক্রমে একাগ্র ও নিরুদ্ধ করাই যোগ।
স্বামী সুন্দরানন্দের ‘যোগচতুষ্টয়’ থেকে