“বৃত্তয়ঃ পঞ্চতয্যঃ ক্লিষ্টাহক্লিষ্টাঃ।”—বৃত্তি পাঁচপ্রকার। সেইগুলি ক্লেশযুক্ত বা ক্লেশশূন্য। ক্লেশ পাঁচপ্রকার—অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ, অভিনিবেশ: সবার মূল হল অবিদ্যা। কিন্তু এই অবিদ্যা ধারণা করা সহজ নয়। ক্লেশের অর্থ হল চেতনার সংকোচ; তার মূল রাগ, দ্বেষ—সুখানুশযী রাগ, দুঃখানুশয়ী দ্বেষ। অনুশয়ীর অর্থ হল—যে all along সুপ্তরূপে চিত্তের ভিতর থেকেছে। সুখের স্বীকার আর দুঃখের পরিহার হল নিজের সংস্কারে। অনুশয়কে আশয় বলা যেতে পারে; এই সংস্কার একপ্রকার অনাদি। আজকালকার ভাষায় আমরা বলি, we inherit them—ভোগায়তন (স্থূল শরীর)-এর সাথে সাথে। ন্যায়দর্শনে তাকে বলে ‘জীবনযোনিপ্রযত্ন’। জীবনকে বাঁচিয়ে রাখবার এই প্রযত্ন সতত কার্য্যশীল থাকে। সুখ দুঃখের এই দোলা সবার লাগে, কিন্তু অবিদ্যার কারণে আমরা তার গভীরতা বুঝতে পারিনা। যখন দুঃখ তীব্র, হয় তখন আমরা তার সম্বন্ধে সচেতন হই, তাকে দূর করবার চেষ্টা করি। দুঃখ দূর করবার লৌকিক উপায়ে যখন দুঃখ দূর হয় না, তখন তাকে দূর করবার অন্য উপায় গ্রহণ করি, তখন হয় বিবেকের শুরু। সুখ দুঃখ থেকে বিযুক্ত হয়ে থাকবার শক্তি আসে তিতিক্ষা থেকে—এই হল গীতার প্রথম উপদেশ। “মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ। আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।”—মাত্রাস্পর্শ—(limited contacts), বাইরের সুখদুঃখ-শীতোষ্ণ ইত্যাদি হল অনিত্য, তা আসে আর যায়—তাকে তুমি সহ্য করো। তিতিক্ষার ধাতু হল তিজ্—তীক্ষ্ণ করা, ধারালো করা:— চেতনাকে এমন তীক্ষ্ণ করা যাতে তা সুখদুঃখের ঊর্দ্ধে উঠে যায়—তিতিক্ষা হতে বীর্য্য জাগ্রত হয়—এরজন্যও দুঃখের প্রয়োজন আছে। দুঃখের আঘাত আত্মাকে সচেতন করে; সেই শক্তিই ক্রমশঃ মনুষ্যকে সুখ-বাসনার ঊর্দ্ধে নিয়ে যায়। বীর্য্যের এই সাধনা হল বিশেষ করে মুনি; পন্থার ধর্ম। এ হল সমস্ত প্রকৃতিকে নাড়া দিয়ে আত্মাকে সবার উপরে উঠিয়ে সব কিছুর উপর বিজয়প্রাপ্ত করে মহাবীর করা। প্রত্যেক যোগীর জন্য তিতিক্ষার অভ্যাস হল অপরিহার্য্য।
রাগ দ্বেষের একদিকে আছে অভিনিবেশ আর একদিকে অস্মিতা। রাগ, দ্বেষ, আর অভিনিবেশ—এইগুলি হল তিনটি গুণের পরিণাম। রাগ হল আসক্তি, দ্বেষ (disliking) ভালো না লাগার অনুভূতি; অভিনিবেশ হল—আচ্ছন্নতা, চেতনাকে ডুবিয়ে দেওয়া, নিদ্রাভাব। রাগ হতে সত্ত্বগুণের উন্মেষ হয়, দ্বেষ রজোগুণে এবং অভিনিবেশ তমোতে পরিপূর্ণ। এই গুণ অস্মিতাতে পাওয়া যায়। অস্মিতার অর্থ অহং। অহং আত্মা নয় বরং তার নকল। “আমি আছি” এই বোধকে আশ্রয় করে রাগ, দ্বেষ আর অভিনিবেশের ক্রিয়া চলে। দৃশ্য আর দর্শন শক্তির একতাকে অস্মিতা বলা হয়েছে। দর্শন শক্তি হল অনুভব করবার ক্ষমতা—ইন্দ্রিয়ের দ্বারা, মনের দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা। বুদ্ধি হল অস্মিতার চরম আশ্রয়।
শ্রীমৎ অনির্বাণ রচিত ‘অনির্বাণ আলোয় পাতঞ্জল যোগ-প্রসঙ্গ’ থেকে