বৃথা দুঃখ গড়িয়া লইয়া অসহনীয় মর্ম্মদাহে নিরর্থক দহিয়া মরিও না। একটু ভাবিয়া দেখ ভাই, প্রকৃতই দুঃখিত হইবার সঙ্গত কারণ কিছু আছে কি না। প্রতীয়মান ব্যাপারের বাস্তবতার বিচার অণুমাত্র করিলাম না, কাণ্ডজ্ঞানের ব্যবহার করিতে চাহিলাম না, যাহা কিছু উত্তেজকতার মুখোশ পরিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল, তাহারই দর্শনে অস্থির হইয়া পড়িলাম—এইরূপ মানসিক অধৈর্য্য প্রশংসনীয় নয়। কিসের তোমার দুঃখ—অপরে তোমাকে মানে না, তাতে কি যায় আসে? বিশ্বের সমগ্র নরনারীও যদি তোমার কথায় ওঠে, কথায় বসে, তথাপি তাহাদের ইচ্ছা তোমার রোমকূপের একটি রন্ধ্র বৃহত্তর করিতে পারে না, একটি পক্ককেশকে ঘনকৃষ্ণ করিবার সামর্থ্য রাখে না। আবার, সকলেই যদি তোমায় ছাড়িয়া যায়, সকল সতীর্থ যদি নির্ব্বিশেষে জীর্ণ কন্থার ন্যায় তোমার প্রাণগত আদর্শের প্রভাবকে পরিত্যাগ করে, তথাপি তোমার পূর্ণতার সম্ভাব্যতা লুপ্ত হইবে না, তোমার সিদ্ধিপথ অগম্য রহিবে না। তুমি জীবন্ত রহিয়াছ, তোমার নিজেরই প্রাণময় প্রেম দিয়া,—অপরে আসিয়া তোমার আত্মার অমৃত-ভাণ্ডার রসে ভরিয়া দেয় নাই। সকল কণ্টক তুমি শোণিতসিক্ত চরণে বিদলিত করিয়া পথ বাহিয়া চলিয়াছ—আপন পৌরুষে, সহচরেরা তাহাদের চাটুকারিতার অসম লঘুত্বে তাহা সুগম করিয়া দেয় নাই। তোমার অতীত তুমি নিজ হাতে গড়িয়াছিলে, তোমার জীবন অপরে গড়িয়া দেয় নাই। তোমার ভবিষ্যৎ তুমিই নির্ম্মাণ করিয়া লইবে, উহাতে অপরের কোন হাত নাই। তোমার স্বকীয় সাধনায় তুমিই সর্ব্বেসের্ব্বা, তুমিই ইহার সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের একমাত্র নিয়ন্তা। তুমি যদি ভোজ্যপানীয় গ্রহণ না কর, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করিয়া দাও, কে তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে? তুমি যদি ব্রহ্মচর্য্যে, ব্যায়ামাভ্যাসে, তৈলাভ্যঙ্গে নিয়মিত হও, তোমার পেশীর শক্তি এবং দেহের কান্তির পরিবর্দ্ধনে বাধা কে দিতে পারে! জগতের ইতিহাস একবার অধ্যয়ন করিয়া বল দেখি, কে কবে কাহাকে বড় করিয়া দিয়াছিল? সকল স্থানে এবং সকল কালে মানুষ বড় হইয়াছে,—নিজের শক্তিতে, পরানুগ্রহে নয়। যাহারা তোমাকে মানিতে চাহে না, তাহারা মানিয়াও তোমাকে বড় করিতে পারে না, এই খাঁটি সত্য কথা জ্বলন্ত অক্ষরে মনের ফলকে লিখিয়া লও। দেখিবে, দুঃখ নিমেষকাল রহিবে না।
নাই বা গ্রাহ্য করিল, তাহাতে যায় আসে কি? ক্ষতিবৃদ্ধি কতটুকু? আমি যদি যথার্থই স্বদেশকে অখণ্ড-হৃদয়ে ভাল-বাসিয়া থাকি, উহাদের উপেক্ষায় দেশ আমাকে ফেলিয়া দিতে পারিবে না। দেশের সাধ্য নাই যে, সে আমার প্রাণভরা ‘‘মা’’-ডাক শুনিয়া নিশ্চল ও নিঃস্তব্ধ হইয়া নির্জ্জীবের মত থাকিতে পারে। আমি ডাকিলে দেশ-জননীর স্তন বাহিয়া পায়োধারা বহিবেই, আমি কাঁদিলে তাঁর নয়ন বাহিয়া মুক্তা ঝরিবেই, উত্তেজিত কণ্ঠে আর্ত্তনাদ তুলিলে তাঁহার বক্ষঃ বেদনায় দুরু দুরু করিবেই? ইহাকে রোধ করিতে কি তাহারা পারিবে, যাহারা একটা স্বার্থের মোহে, বিলাসের বিভ্রমে তোমার কাজে সাময়িক ভাবে আপন ঢালিয়া দিয়াছিল? দেশকে ভাল বাসিয়া ইহারা আসে নাই,—আসিয়াছিল একটা কৌতুক দেখিতে।
শ্রীশ্রীস্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের ‘কর্ম্ম-ভেরী’ থেকে