একাধিক সূত্রে অর্থপ্রাপ্তি ও ঋণশোধে মানসিক ভাব মুক্তি। নিজ বুদ্ধি ও দক্ষতায় কর্মোন্নতি ও সুনাম। ... বিশদ
অগ্নিমীলে পুরোহিতম্।/ যজ্ঞস্য দেবম্ ঋত্বিজম্।/ হোতারং রত্নধাতমম্।।
মন্ত্রটির দ্রষ্টা ঋষি বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা। মন্ত্রটির ছন্দ গায়ত্রী। তিন পাদ। প্রত্যেক পাদে ৮ টি অক্ষর। যজ্ঞে অত্যাবশক বস্তু অগ্নি। মন্ত্রটি অগ্নির স্তব। যজ্ঞ বলিতে কী বুঝি তাহা সর্বাগ্রে আলোচ্য। অগ্নিতে ঘৃত-আহুতি দান হইল যজ্ঞের বাহিরের দৃষ্ট রূপ। দেবতার উদ্দেশ্যে এই আহুতি। ঘৃত শব্দের অর্থ অনির্বাণ বলেন—‘জ্যোতির ধারা’। ঘৃ ধাতুর অর্থ দীপ্ত হওয়া। যজ্ঞ কর্ম করার ফল কী? গীতা বলেন—“দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।/ পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ।।”
যজ্ঞ দ্বারা তোমরা দেবগণকে সংবর্ধনা কর। দেবগণও তোমাদিগকে সংবর্ধিত করুন। এইরূপ পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে। দেবতার উদ্দেশ্যে যে দ্রব্য ত্যাগ বা দ্রব্য উৎসর্গ তাহার ফল দেবতাদের সঙ্গে সাযুজ্য। এই সাযুজ্য ঘটিলে শ্রেয়ঃ লাভ হয়। শ্রেয়টি কী? বিশ্বের ছন্দের সঙ্গে জীবনের ছন্দের একাকারতা। মন্ত্রটিতে বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুচ্ছন্দা বলিতেছেন—আমি অগ্নিকে স্তব করি। অগ্নি যজ্ঞে পুরোহিত, অগ্নি হোতা, অগ্নি দীপ্তিমান্। অগ্নি যজ্ঞে ঋত্বিক্, অগ্নি রত্নধারী, উৎকৃষ্ট রত্নদাতা। অগ্নি যজ্ঞে দিব্য ঋত্বিক্। ঋতুর রহস্যজ্ঞান না থাকিলে তিনি ঋত্বিক্ হইতে পারেন না। ঋতু শব্দটি উপলক্ষণ—ঋতু বলিতে বর্ষাদি ঋতু, অগ্রহায়ণ প্রভৃতি মাস, পূর্ণিমা-অমাবস্যাদি তিথি, অশ্বিনী প্রভৃতি নক্ষত্র—যজ্ঞের কাল বুঝায়। যিনি ঋতুর তত্ত্ব জানেন গীতার ভাষায় তিনি অহোরাত্রবিদ্ অহর্বিদ্। কোন্ সময় কোন্ যজ্ঞ কোন্ ভাবে হইবে ইহা যিনি জানেন তিনি ঋত্বিক্। অগ্নি ঋত্বিক্। নিজেই নিজের যজ্ঞ করেন। বস্তুতঃ যজ্ঞ আমি করি না, আমার মধ্য দিয়া তিনিই আহুতি দেন। তাঁহার কৃপায় হৃদয়ে জাগে আকুতি। আকুতির ফলে আসে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা আমাকে প্রবর্তিত করে যজ্ঞকর্মে। যজ্ঞ হয় ভিতরে ও বাহিরে। বাহিরের যজ্ঞ যজ্ঞবেদীতে। অন্তরের যজ্ঞ হৃদয়ের অভ্যন্তরে।
যজ্ঞ সম্পন্ন করিতে যাহা প্রয়োজন তন্মধ্যে পুরোহিত সর্বপ্রধান। পুরঃ অর্থাৎ অগ্রভাগে সম্মুখে যিনি। স্থাপিত অগ্নি আর অগ্রণী কেমন যেন একই কথা। সকলের অগ্রণী অগ্রে গমনকারী সম্মুখে সংস্থাপিত অগ্নি। অগ্নি আমাদের দেওয়া দ্রব্য দেবতাদের নিকট লইয়া যান। আমরা দেই ঘৃতাহুতি। ঘৃত হইল দুগ্ধের নির্যাস। দুগ্ধ হইল সত্ত্বগুণ, তাই শুভ্র। গাভী কালো হউক, লাল হউক দুগ্ধ কিন্তু শুভ্রই। আমরা লোক ভালই হই আর মন্দই হই—আমাদের মধ্যে সত্ত্বগুণ আছেই—না থাকিলে সত্তাই থাকিত না। কবিত্ব থাকিলেই কবিতা হয়। সত্ত্বগুণ থাকিলেই সত্তাটা বজায় থাকে। দুগ্ধ ঘনীভূত হইলে দধি। তাপ দিয়া সকল মলিনতা নিঃশেষ করিয়া দিলে হয় ঘৃত। ঘৃত শুদ্ধ সত্ত্বের প্রতীক। ঘৃত আমাদের নির্মল আনন্দ চেতনা। তাহা আমরা দেই দেবতাদের উৎসর্গ করিয়া। তারপর অগ্নি কেবল তাহা দেবতাদের হাতে পৌঁছাইয়া দেন না, অগ্নি দেবতাদেরও পুরোহিত কিনা—তাই দেবতারা যাহা আমাদিগকে প্রদান করেন তাহাও লইয়া আসেন আমাদের সমীপে। দেবতারা দেন তাঁহাদের শুভ আশীর্বাদ—কল্যাণময় প্রসাদ। সেই প্রসাদে “সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে।” দুঃখের নিবৃত্তিই শ্রেয়ঃ পদবাচ্য।