শ্রীকৃষ্ণের লীলা একটি খেলার মতন তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। আমাদের লৌকিক খেলাতেও চারিটি পক্ষ থাকে। সপক্ষ, বিপক্ষ, সুহৃৎপক্ষ ও তটস্থ পক্ষ। মনে করুন ফুটবল খেলা হইতেছে। ইহাতে সপক্ষ ও বিপক্ষ আমরা সকলেই বুঝি। সুহৃৎপক্ষ একটু বোঝানো দরকার। সুহৃৎপক্ষ থাকে দর্শকদের মধ্যে। সুহৃৎপক্ষ দুইভাগ। কাহারও এই পক্ষের জয়ে আনন্দ। কাহারও বা অপর পক্ষের জয়ে আনন্দ। তটস্থ পক্ষ কোনও পক্ষেরই জয়-পরাজয়ে আনন্দ বা বিষাদ নাই—খেলা দেখিতেছে আনন্দ, জয়-পরাজয়ে কোনও পক্ষপাতিত্ব নাই। খেলার সময়ে অতি প্রিয়জনও বিপক্ষে যাইতে পারে। খেলার শেষে আর বিপক্ষ ভাব থাকে না। সেইরূপ শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী সহোদরা ভগ্নীর মতন। খেলার সময়ে তাঁহারা দুইপক্ষ। খেলার অন্তে তাঁহাদের বিরুদ্ধভাব থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছাড়িয়া যখন মথুরা যান তখন তাঁহাদের দুইজনের পরস্পরের প্রতি বিরোধভাব আর থাকে না। লীলা একটি খেলা বা অভিনয়ের মতন। অভিনয় অভিনয়ের মতন করিয়া দেখিলে আনন্দ হয় না। অভিনয় তন্ময় হইয়া দেখিতে হয়। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ অভিনয় দেখিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় অভিনয় দেখিতে দেখিতে এত তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন যে একবার রাগ করিয়া মঞ্চে জুতা ছুড়িয়া মারিয়াছিলেন। নীলচাষের অভিনয়ে সাহেবের প্রতি এত অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, মঞ্চে সাহেবের উদ্দেশ্যে জুতা ছুড়িয়া মারিয়াছিলেন। পরে অনেক কষ্টে তাঁহাকে ইহা অভিনয় এইরূপ বুঝাইয়া তাঁহার ক্রোধ উপশম করানো হইয়াছিল। লীলার কথা বলিতে ও শুনিতে অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন। অযোগ্য হইয়া যদি বলি বা শুনি তাহাতে কল্যাণ না হইয়া বরং বিপরীত কিছু হইবার সম্ভাবনা।
মানলীলা—শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা বোঝা কঠিন, তন্মধ্যে মানলীলা সর্বাপেক্ষা কঠিন।
স্বপক্ষ ও বিপক্ষ—শ্রীরাধা ও চন্দ্রাবলী পরস্পর বিপক্ষ। যাহারা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন তাহাদিগকে পরস্পরের বিপক্ষ পক্ষ বলা হয়। বিপক্ষের দু’টি কাজ—ইষ্টহানি ও অনিষ্ট সাধন। শ্রীরাধার অপেক্ষায় শ্রীকৃষ্ণ কুঞ্জে বসিয়া আছেন। ইহা জানিতে পারিয়া চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মা চন্দ্রাকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণের নিকটে আসিয়াছেন। সুবলের নিকট শ্রীরাধা এই বিবরণ শুনিয়া কী অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন বৃন্দা তাহা শ্রীকৃষ্ণকে বলিতেছেন—হে মুকুন্দ! সুবল শ্রীরাধারানীর নিকট গিয়া বলিলেন—“পদ্মা চন্দ্রাকে শ্রীকৃষ্ণের কাছে নিয়াছেন।” সুবলের মুখে এই কথা শোনামাত্র শ্রীরাধা স্তব্ধতা প্রাপ্ত হইলেন। পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত শ্রীরাধার স্তব্ধতা বিরাজমান ছিল। ইহার নাম ইষ্টহানি।
অনিষ্টকারীঃ শ্রীরাধার শাশুড়ী জটিলা চন্দ্রাবলীর সখী পদ্মাকে দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—“তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” পদ্মা বলিলেন—“আমি গোবর্ধনের তটদেশ হইতে আসিয়াছি।”
‘শ্রীমহানামব্রত প্রবন্ধাবলী’ থেকে