আমাদের পূজনীয় আচার্য ব্রহ্মানন্দ যখন বেলঘরিয়া উদ্যানে নির্জ্জন সাধন ভজন করিবার জন্য গমন করিয়াছিলেন, সেই সময়ে আমরা অনেকেই পরমহংসদেবের সহিত পরিচিত হইয়াছিলাম। আমাকে তিনি বড়ই স্নেহ করিতেন। শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত রামকৃষ্ণ-কথামৃত নামে একখানি পুস্তক ও তাঁহার অন্যান্য শিষ্যেরা তাঁহার আধ্যাত্মিক ধর্মের অনেক কথা সাধারণের নিকট প্রকাশ করিয়াছেন; সুতরাং, সেইসকল বিষয় পুনরুক্তি আমার উদ্দেশ্য নহে। তবে আমার সঙ্গে যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা সাধারণের পক্ষে অমূল্য জিনিস মনে করিয়া সংক্ষেপে কয়েকটি ঘটনা লিখিয়া প্রকাশ করিতেছি। রামকৃষ্ণদেব এক অসাধারণ ব্রহ্মশক্তি অন্তরে ধারণ করিয়া বর্ধমানের এক ক্ষুদ্র পল্লীতে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি লেখাপড়া ভাল করিয়া শিক্ষা করেন নাই। অতীতের পল্লীগ্রামস্থ ছেলেরা যতটুকু লেখাপড়া শিক্ষা করিত, তাহাও অতি সামান্যই শিক্ষা করিয়াছিলেন। তাঁহার জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা রানী রাসমনির দক্ষিণেশ্বর ঠাকুরবাটীর পূজারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার নিকট তিনি ঠাকুর পূজার্চনা করিবার জন্য আসিলেন। পার্থিব সুখ ঐশ্বর্যের উপর তাঁহার বাল্যকালে অনাস্থা ছিল। প্রথম হইতেই তাঁহার পিতা তাঁহাকে সংসারে আবদ্ধ করিবার জন্য, তাঁহার পরিণয় ক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া দিয়াছিলেন। ‘বান্দা ভাবেন এক প্রকার আর খোদা করেন অন্য প্রকার।’ তাঁহার পিতার বুদ্ধি কৌশল ভগবান একেবারে চূর্ণ বিচূর্ণ পূর্বক তাঁহাকে আত্মত্যাগী সন্ন্যাসী করিয়া মানবের মঙ্গলের জন্য নিযুক্ত করিয়াছিলেন। তিনি ঠাকুর পুজার্চনারূপ বাহ্যিক কার্য পরিত্যাগ করিয়া নিজে নির্জন সাধন-ভজনে নিযুক্ত হইলেন।
যখন ব্রহ্মানন্দ শুনিলেন যে, দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর বাড়িতে রামকৃষ্ণ নামে একজন ভক্ত সাধু অবস্থিতি করিতেছেন, তখন ব্রহ্মানন্দ তাঁহাকে দর্শন করিবার জন্য বেলঘরিয়ার উদ্যানে তাঁহাকে আনয়ন করিলেন এবং পরস্পরে মুগ্ধ হইয়া উভয়ে একটি আধ্যাত্মিক যোগে আবদ্ধ হইলেন। আমার বোধহয় কেশবচন্দ্রই তাঁহাকে পরমহংস উপাধিতে ভূষিত করিয়া ছিলেন। রামকৃষ্ণদেব সেই সময় হইতে ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রচারক এবং অন্যান্য সাধুচরিত্রের লোক সকল তাঁহাতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন। মহর্ষিদেব ও আদি সমাজ দর্শন করিয়া পরমহংসদেব বড়ই আনন্দ প্রকাশ করিলেন। আমি যে সময়ের কথা লিখিতেছি, সেই সময়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয় নাই এবং নরেন দত্ত, যিনি পরে বিবেকানন্দ নামে অভিহিত হইয়া সকল নরনারীর পূজনীয় ও আদৃত হইয়া গিয়াছেন, সেই সময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন কিনা জানি না। রামকৃষ্ণদেব বড়ই শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। স্ত্রী কি পুরুষ, যিনি একবার তাঁহার মুখের কথা শুনিতেন, তিনি তাঁহাকে ছাড়িতে চাহিতেন না। আমি অনেক বৎসর তাঁহার চরণপ্রান্তে বসিয়া অনেক ধর্মোপদেশ শ্রবণ করিয়াছিলাম; কিন্তু তাঁহাকে কখন কোন সম্প্রদায়ের নিন্দা কি কুৎসা করিতে শুনি নাই।
‘ব্রাহ্ম ও খ্রীষ্টান অনুরাগীদের চোখে শ্রীরামকৃষ্ণ’ থেকে