খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান—বেঁচে থাকার জন্য মানুষের ন্যূনতম চাহিদা। উনিশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব, বিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি এসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তারপর বিশ্বজুড়ে একের পর এক দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে ধাপে ধাপে বদলে গিয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার সংজ্ঞাটি। ঔপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি রাষ্ট্রগুলির সামনে নিজের দেশ নিজে গড়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল। তখন থেকে স্বাধীন দেশগুলিই তাদের নাগরিকদের চাহিদা ও মত অনুসারে ঠিক করছিল রাষ্ট্র পরিচালন ব্যবস্থায় কী কী অগ্রাধিকার পাবে। কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে গরিব কল্যাণ। গরিবদের কাছে জমি কম কিংবা তারা একেবারে ভূমিহীন। তারা অন্যের জমিতে বা কলকারখানায় কাজ করে সংসার চালানোর মতো টাকা রোজগার করে। কিন্তু তাতেও আয়পত্তর মোটেই ভালো হয় না। তাই ন্যূনতম মজুরির দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দেশ বিশেষে ন্যূনতম মজুরি নানারকম। গরিব দেশগুলিতে স্বীকৃত ন্যূনতম মজুরিতেও একটি ছোট পরিবারকে সুখী করে তোলা অসম্ভব। সেখান থেকে এসেছে প্রতিটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, গৃহ, চিকিৎসা, শিক্ষা, কাজ প্রভৃতির অধিকারের কথাটি। গরিব বা দারিদ্র্য সীমার নীচের পরিবারের নিজস্ব আয় থেকে এই অধিকারগুলির একটিও রক্ষা হওয়া সম্ভব নয়। তাই কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে গরিব বা অতি গরিব নাগরিকদের জন্য নানা প্রয়োজনে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছে অর্থনীতি। তাতেও জীবনধারণটা গরিবের কাছে এক যন্ত্রণাই রয়ে যাচ্ছে। তাই গরিবের জন্য সরকারের তরফে কাজের নিশ্চয়তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন ইউপিএ সরকার বছরে অন্তত ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। 
ভারত স্বাধীন হয়েছে সাত দশকের বেশি হল। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও যে এখানে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভূমিকা যথাযথরূপে পালিত হয়নি, তার প্রমাণ এখনও প্রায় ৫০ কোটি মানুষ গরিব। তাদের মধ্যে ৩০ কোটির বেশি মানুষ অতি গরিব। পরিবারের হিসেবে ১০ থেকে ১২ কোটি গরিব পরিবার। নানা ক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকির প্রয়োজনটা যে ফুরিয়ে যায়নি এই লজ্জাই তা বুঝিয়ে দেয়। তবু ভারত সরকার মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি থেকে ভর্তুকি ছেঁটে দেওয়ার, এমনকী তুলে দেওয়ারও মতলবে রয়েছে বহুদিন যাবৎ। যেমন রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি সম্প্রতি তলানিতে এনে ফেলেছে। যেমন সম্প্রতি সিলিন্ডার প্রতি ব্যাঙ্কে ভর্তুকি জমা হয়েছে মাত্র ১৯ টাকা ৫৭ পয়সা। অথচ গত একমাসে দু’দফায় ১০০ টাকা গ্যাসের দাম বেড়েছে। মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা সমস্ত গরিব পরিবারকে কভার করতে পারেননি। এখনও কয়েক লক্ষ গরিব পরিবার এই সুন্দর প্রকল্পটির বাইরে রয়ে গিয়েছে। অনুমান করা যায়, রান্নার জন্য তারা কাঠ পাতালতা ঘুঁটে কয়লা প্রভৃতিকেই জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে। অথচ এগুলি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর সামগ্রিকভাবে ওইসব জ্বালানির ধোঁয়ায় পরিবেশও দূষিত হচ্ছে। 
আরও একটি দুঃখজনক বাস্তব এই যে, দেশের সমস্ত গ্রাম ও জনপদে এখনও কিন্তু বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া যায়নি। লক্ষ লক্ষ পরিবার বিদ্যুতের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত। বেশিরভাগ রাজ্যেই গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ পরিষেবার মান শহরের তুলনায় খারাপ। দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় তাদের কাটাতে হয়। ফলে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকা সত্ত্বেও বহু পরিবারকে বিকল্প জ্বালানির সংস্থান করে রাখতে হয়। বিশেষ করে রাতে আলোর প্রয়োজনে। সেটা অবশ্যই কেরোসিন। কেরোসিন না পেলে যে-কোনও গরিব পরিবারের পক্ষে বেঁচে থাকাটা আরও কষ্টের হয়ে যায়। কিন্তু মোদি সরকার এটা ভাবছে না। কেরোসিনেরও দাম বাড়িয়ে চলেছে। যেমন খুব শিগগির কলকাতায় কেরোসিনের দাম ৩২ টাকা ছাড়াতে চলছে। এক লাফে দাম ৪ টাকা বৃদ্ধির কারণেই এই দুঃসংবাদ। গরিব এমনিতেই ভালো থাকে না। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ভীষণ খারাপ আছে। তার ভিতরে এই ‘সামান্য ক্ষতি’ না করলেই নয়! মোদি সরকারের মস্তিষ্ক যাঁরা, একটু ভাবুন—দয়া করে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করুন গরিবের কষ্টটা।