সঠিক বন্ধু নির্বাচন আবশ্যক, কর্মরতদের ক্ষেত্রে শুভ। বদলির কোনও সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। শেয়ার বা ... বিশদ
স্ট্যানফোর্ডের বাড়ির ডোরবেলের সিকিউরিটি ক্যামেরায় নোটিফিকেশন পেয়ে ফালতু কল ভেবে একটু আগে বব উইলসনও নিজেই তাঁর বাড়ির ফোনটির প্লাগ খুলে রেখেছিলেন। তাঁকে না পেয়ে নোবেল কমিটি থেকে খবরটি তাইর স্ত্রী ম্যারিকে দেওয়া হয়। জানানো হয়, রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতির উদ্দেশে সেভেরিজেস রিকসব্যাঙ্ক প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্স পুরস্কার ২০২০ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক পল মিলগ্রম ও রবার্ট উইলসনকে প্রদান করেছে। তাঁরা ‘নিলামতত্ত্ব সমৃদ্ধ করেছেন এবং নিলামের নতুন ফরম্যাট আবিষ্কার করেছেন’।
গত ৫২ বছরে নোবেল কমিটি ৮৬ জন অর্থনীতিবিদকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করেছে। পল ও বব যথাক্রমে ৮৫ ও ৮৬তম নোবেল লরিয়েট। এই নিয়ে রবার্ট উইলসনের সরাসরি তিন ছাত্র অর্থনীতির নোবেল পেয়েছেন। আলভিন রথ ২০১২ সালে, বেঙ্গট হোমস্ট্রম ২০১৬ সালে এবং পল মিলগ্রম ২০২০ সালে শিক্ষক রবার্ট উইলসনের সঙ্গে। নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন এমন আরও কজন ছাত্রের নাম আলোচনায় আসছে।
পল ও বব একই লক্ষ্যে অর্থনীতি বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের যৌথ উদ্যোগ নিয়ে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি বলেছে: তাঁদের আবিষ্কার সমাজকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছে। নব্য অর্থনীতির সফল ঘটক দু’জন, ঘটকালিটা মানুষের কল্যাণে এসেছে এবং বাজার পরিকল্পনায় ঝুঁকি ও ত্রুটি কমে এসেছে।
কে এই রবার্ট বাটলার উইলসন জুনিয়র?
জন্ম ১৬ মে ১৯৩৭ নেব্রাস্কায়। স্কুল ফাইনাল সেখানেই। মেধাবী বব উইলসন পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। ১৯৫৯ সালে গ্র্যাজুয়েট এবং ১৯৬১-তে এমবিএ ডিগ্রি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টর ইন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ১৯৬৩ সালে। তারপর কিছুদিন তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৪ থেকেই স্ট্যানফোর্ড বিজনেস স্কুলের ফ্যাকাল্টি। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত হার্ভার্ড ল স্কুলের এফিলিয়েটেড ফ্যাকাল্টি হিসেবে কাজ করেছেন।
রবার্ট উইলসন অর্থনীতির গেম থিওরি এবং তার প্রায়োগিক জ্ঞানে বিশ্বনন্দিত একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর গবেষণা ও শিক্ষকতাজীবন যেসব বিষয়কে ধারণ করে আছে তার মধ্যে রয়েছে বাজার পরিকল্পনা, মূল্য নির্ধারণ, দরকষাকষি, তথ্য অর্থনীতি, শিল্প সংগঠন, নিলাম পরিকল্পনা, জ্বালানি, প্রযুক্তিগত যোগাযোগ, বিদ্যুৎ প্রভৃতি খাতে প্রতিযোগিতামূলক ডাকের পদ্ধতি নির্ধারণ। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর দ্য থিওরি অব সিন্ডিকেটস কয়েক প্রজন্ম ধরে ইকোনমিকস, ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিংয়ের শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে যাচ্ছে। তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। বহুসংখ্যক জার্নালের তিনি সহযোগী সম্পাদক। এখনও তিনি তাঁর ছাত্র-গবেষকদের কাজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং এগুলোর মানোন্নয়নের জন্য উদারভাবে পরামর্শ দিয়ে যান। তিনি উপদেষ্টা হিসেবে মার্কিন সরকারকে তেল কোম্পানির জন্য অফশোর লিজিংয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ভোক্তার ভার কমাতে চেষ্টা করেছেন। অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিষেবা পদ্ধতি পরিকল্পনা, পাইকারি বাজার পরিকল্পনা, পরিবেশ ও আবহাওয়াজনিত দুর্যোগ ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ, অতিপ্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণসহ বিভিন্ন কাজে তিনি যুক্ত হয়েছেন। নোবেল কমিটি তাঁর অনেক কাজের মধ্যে নিলামে মূল্য নির্ধারণী গবেষণাকে সামনে নিয়ে এসেছে এবং অর্থনীতিতে তাঁর ও তাঁর সহকর্মী পল মিলগ্রমের উদ্যোগের অবদানের স্বীকৃতি জানাতে উভয়কে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করেছে।
বব উইলসন দুনিয়ার সেরা শিক্ষক তো বটেই। আলভিন রথ নিজে ২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর শিক্ষক বব উইলসন সম্পর্কে লিখেছেন: স্ট্যানফোর্ডে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আসা জেরুজালেম হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মাইকেল মাশলারের একটি ক্লাস করার পরই আমি সিদ্ধান্ত নিই গেম থিওরি হবে আমার গবেষণার বিষয়। বব উইলসন আমার তত্ত্বাবধায়ক হতে রাজি হলেন। শুধু তা-ই নয় পিএইচডির জন্য যোগ্য হতে যেসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় তাঁর একটিতে আমি পাস করতে না পারলেও তিনি তা সামলে নেন। সেই বছরটা ছিল তাঁর ছুটির বছর। তবুও তিনি প্রতি সপ্তাহে একদিন আমার জন্য ১ ঘণ্টা বরাদ্দ রেখেছিলেন। আমার স্মৃতিতে যা আছে, তা হচ্ছে আমাদের প্রতিটি সাক্ষাতের পর আমার জন্য অনিবার্য হয়ে উঠত একটা নতুন কিছু পড়া। আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম গত এক সপ্তাহে আমার কেন তেমন অগ্রগতি হয়নি। আর তিনি বলতেন এতে নিরুৎসাহিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমি বলতাম, আমার কাজে কিছু দূর এগিয়ে আটকে গিয়েছি। আমাদের আলোচনার শেষদিকে তিনি আমাকে একটা বিশেষ কোনও পেপার পড়ার কথা বলে দিতেন। তিনি যা বলতেন তা বরাবরই ছিল লক্ষ্যভেদী। তার অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা লাইব্রেরিতে। বেশ খানিকক্ষণ পড়ার পর বুঝতে পারলাম বব নিশ্চয়ই ভুল করেছেন। এই পেপারের সঙ্গে আমার অগ্রগতি আটকে যাওয়ার সম্পর্ক কোথায়? তারপর পেপারের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছে হঠাৎ একটা ইঙ্গিত বা মন্তব্য পেয়ে গেলাম, যা আমার অগ্রগতির বাধাটিকে কাটিয়ে দিল। বব উইলসন এভাবেই আমাদের শিখিয়েছেন।
২০১৬ সালের নোবেল বিজয়ী ফিনল্যান্ডের বেঙ্গট হোমস্ট্রম তাঁর শিক্ষক রবার্ট উইলসন সম্পর্কে লিখেছেন:
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসে তখন পর্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন বব উইলসন। বয়স তখনও তাঁর ৪০ হয়নি। দেখতে আরও ১০ বছর কম মনে হয়। তাঁর প্রভাব স্কুলের ডিসিশন সায়েন্স গ্রুপ বাইরে বহুদূর ছড়িয়ে। আমি অর্থনীতিতে ববের প্রথম যে ক্লাসটিতে যোগ দিই, তা ছিল তার আইকনিক মাল্টিপারসন ডিসিশন থিওরি প্রতি বছরই কোর্সের ধরন পরিবর্তন হয়। আমি তিনবার তাঁর এই ক্লাস করেছি। ববের পড়ানোর ধরন আমার মনে স্থায়ী দাগ কেটেছে। তিনি কোনও পেপারের সমালোচনা করা বা পেপার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করায় আগ্রহী ছিলেন না। বরং যে প্রশ্নটিকে ঘিরে পেপারটি রচিত হয়েছে তিনি তা নিয়ে আলোচনা করতে এবং প্রশ্নটি কেমন করে অর্থনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তা বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করতেন এবং অঙ্ক ও সংখ্যা দিয়ে বিশ্লেষণ সম্ভব একটি গাণিতিক মডেল উপস্থাপন করতেন।
রবার্ট উইলসনের শিক্ষার্থীদের একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য ছিল ববের পাঠচক্র। অর্থনীতির বিভিন্ন শাখা-উপশাখার গবেষকরা এতে যোগ দিতেন। এর কোনও ধরা-বাঁধা কাঠামো ছিল না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যার কিছু বলার আছে তিনি ব্ল্যাকবোর্ডে চলে যেতেন, একটি মডেলের খসড়া দাঁড় করাতেন। এখান থেকে চিন্তা করার মতো অনেক বিষয় বেরিয়ে আসত— এটা ছিল মজার ক্লাস। কিছুটা আতঙ্কেরও। কিন্তু সব সময়ই অনুপ্রেরণাদায়ক। পিএইচডি গবেষণায় উপদেষ্টা হিসেবে তিনি গবেষকদের উদারভাবে সময় মঞ্জুর করতেন, কিন্তু তাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুযোগ দিতেন না। ববের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারাটাতেই ছিল উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা নিয়ে ফিরে আসার নিশ্চয়তা।
আমি কখনও তাঁর অফিসে খালি হাতে যাওয়ার ধৃষ্ঠতা দেখাইনি। শেষ মুহূর্তে হলেও একটি কিছু লিখে তাঁর কাছে জমা দিয়েছি। খারাপ হলেও এটা কিছুই হয়নি, এই ধরনের কঠোর মন্তব্য তিনি করতেন না। তাঁর তিন নোবেলজয়ী ছাত্রের নোবেলপ্রাপ্তি ঘটেছে বয়সের রিভার্স অর্ডারে। কম বয়স থেকে বেশি বয়সে। পল মিলগ্রম তাদের মধ্যে অন্যতম। তবে তাঁর অধীন পিএইচডির হিসেবে অর্ডার ঠিক আছে বলতে হবে। রথ করেছেন চুয়াত্তরে, হোমস্ট্রম আটাত্তরে, মিলগ্রম ঊনআশিতে। পল ও ববের মধ্যেই সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। নিজের নোবেল পাওয়ার কথা শুনে তাঁরই মনে হতে পারে, তাঁর শিক্ষক বব উইলসন কেন বাদ যাবেন। অর্থনীতির ঐতিহাসিকদের চোখে ‘বব উইলসন রাজবংশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বব উইলসনের পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড রাইফা (১৯২৪-২০১৬) আর তাঁর তত্ত্বাবধায়ক মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কোপল্যান্ড (১৮৯৮-১৯৭০) তারা প্রত্যেকেই অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনার দিকপাল।