শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্ত শত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত ... বিশদ
শারীরিক অসুস্থতার জন্য দীর্ঘদিন সকলের শ্রদ্ধেয় ছবি বিশ্বাস মঞ্চে অভিনয় করতে পারেননি। অথচ একসময়ে নিয়মিত তিনি মঞ্চ কাঁপাতেন। তাঁর অমন সুন্দর চেহারা, পরিশীলিত বাচনভঙ্গি দর্শকদের আকর্ষণ করত। সেই সময়ে প্রখ্যাত নাট্যকার ও নির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত মনোজ বসুর কাহিনি অবলম্বনে ‘ডাকবাংলো’ নাটক মঞ্চস্থ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘স্টার থিয়েটারে’ (৭৯/৩/৪ বিধান সরণী)। চরিত্রের নাম বিশ্বেশ্বর। ইতিহাস চর্চায় নিমগ্ন-প্রাণ। আত্মভোলা এক মানুষ। চরিত্রটির রূপসজ্জা কেমন হবে তাই নিয়ে আলোচনা করলেন দেবনায়ারণ ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে। আলোচনায় ঠিক হয় কাঁচা-পাকা পরচুল, বাঁধা দাড়ি গোঁফ এটাই হবে বিশ্বেশ্বরের রূপসজ্জা। মেকআপ ম্যান ডেকে উইগ, দাড়ি, গোঁফ তৈরি হয়ে এল। এসে গেল ফুল রিহার্সালের দিন। ছবি বিশ্বাস দেবনারায়ণ গুপ্তকে ডেকে বললেন, ‘দাড়ি আমি রাখতে পারছি না ভাই, বড্ড কষ্ট হচ্ছে।’ অগত্যা দেবনারায়ণ সম্মত হলেন, ‘দাড়িটা তবে বাদ দিন।’ ছবি বিশ্বাস দাড়িটা খুলে দেবনারায়ণ বাবুর হাতে তুলে দিলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ছবি বিশ্বাস। পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনীত হতে থাকল ‘ডাকবাংলো’ নাটকটি। ১৯৫৯ সালের ১২ মার্চ ‘ডাকবাংলো’ নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছিল।
কয়েকদিন অভিনয়ের পর ছবি বিশ্বাস আবার ডাকলেন দেবনারায়ণ গুপ্তকে। পরিচালক ছুটে এলেন, ‘কী ব্যাপার ছবিদা? ডাকছেন?’
ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘দেখ, উইগটা তো মাথায় রাখতে পারছি না, একে দেখ ব্লাড প্রেসার, তার ওপর ন’বছরের মধ্যে স্টেজে এসব মাথায় চাপাইনি। উইগ চাপানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মাথার ভেতর দপ দপ করতে আরম্ভ করে। তুমি যদি পারমিশান দাও, তবে উইগটা বাদ দিই।’ সেদিন ছিল রবিবার। পেশাদারি মঞ্চগুলিতে রবিবার ডাবল শো থাকে। দেবনারায়ণ বললেন, ‘আজ তো রবিবার। ডাবল শো। আপনি প্রথম শো’তে উইগ পরেই করুন। দ্বিতীয় শোতে উইগ খুলে ফেলবেন। মাথায় বরং হোয়াইট ইংক দিয়ে সাদা করে নেবেন।’ উইগটা অবশেষে বাদ গেল। রইল পরে শুধু গোঁফটি। স্পিরিট গাম ছবি বিশ্বাসের স্কিনে সহ্য হতো না। স্পিরিট গাম লাগালেই ঘা হয়ে যেত। শুকোপটি দিয়ে ছবি বিশ্বাসের গোঁফ আঁটা হতো। ছবি বিশ্বাস সেই সময়ে সিনে যাওয়ার আগে গোঁফটি লাগাতেন, সিন থেকে বেরিয়ে এসেই গোঁফটি খুলে ফেলতেন। গোঁফটি হাতে আটকে রাখতেন। অনেকদিন দেবনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে সতর্ক করেছেন, ‘দাদা গোঁফ সাবধান।’ ছবি বিশ্বাস হেসে বলতেন, ‘নিশ্চয়ই, ও কী ভুল হবার জো আছে ভাই?’ তারপরেই সুকুমার রায়ের কবিতার দু’লাইন আবৃত্তি করে বলতেন; ‘গোঁফের আমি, গোঁফের তুমি গোঁফ দিয়ে যায় চেনা।’
‘ডাকবাংলো’ নাটকের শততম অভিনয় রজনী অতিক্রান্ত হয়েছে। একদিন দেবনারায়ণবাবু উইংস-এর ধারে এসে দেখেন ছবি বিশ্বাস স্টেজে পার্ট করে চলেছেন কিন্তু গোঁফটি হাতে আটকানো আছে। সিনটি শেষ হলে দেবনারায়ণবাবু ছবি বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দাদা আপনার গোঁফ?’ ছবি বিশ্বাস তৎক্ষণাৎ গোঁফে হাত দিলেন। তারপর নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখেলেন গোঁফটি হাতেই রয়েছে। আঁটা হয়নি। অবাক হয়ে বললেন, ‘এবার কী হবে?’ দেবনারায়ণবাবু বললেন, ‘কী আর হবে? পরের সিনে গোঁফটা এঁটে নেবেন।’ ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘দর্শকেরা কী মনে করবে?’ দেবনারায়ণ আশ্বস্ত করে বললেন, ‘মনে করলে সিনেই মনে করত। এতক্ষণে দর্শকদের মধ্যে থেকে গুঞ্জন শোনা যেত। তা যখন হয়নি, তাতে এটাই প্রমাণিত যে দর্শকেরা ছবি বিশ্বাসের অভিনয়টাই দেখতে এসেছেন, মেকআপ দেখতে আসেননি।’
ছবি বিশ্বাস বললেন, ‘বলছিস? তা’হলে এক কাজ কর ভাই, পরের দিন থেকে গোঁফটাও বাদ দিয়ে দে।’
দেবনারায়ণ বললেন, ‘তাই হবে। দরকার নেই ঝামেলার।’
সেদিনের মতো অভিনয় শেষ হলে ছবি বিশ্বাসের ঘরের ড্রেসার কাগজের একটা মোড়ক দেবনারায়ণ গুপ্তের হাতে তুলে দিলেন আর বললেন, ‘ছবিবাবু এটা পাঠিয়েছেন।’ খুলে দেবনারায়ণবাবু দেখলেন, ‘বিশ্বেশ্বরের গোঁফ। আর তার সঙ্গে এক টুকরে কাগজে, ভুরু, পেনসিল দিয়ে ছবি বিশ্বাসের লেখা; ‘ঝামেলা ফেরত দিলাম, প্রাপ্তি সংবাদ দিস। ইতি—তোর ছবিদা।’ এই হলেন ছবি বিশ্বাস। এই ‘স্টার থিয়েটারের পর পর নাটকগুলিতে তিনি অভিনয় করলেন। সেই তালিকায় আছে পরমারাধ্য শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রেয়সী নাটকগুলি। মারা যাওয়ার সময়েও তিনি স্টার থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেটি সুবোধ ঘোষের লেখা ‘শ্রেয়সী’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। তারও নির্দেশক ছিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। ১৯৬০ সালের ১১ আগস্ট ‘শ্রেয়সী’র প্রথম অভিনয়, নায়িকা যদিও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, তবে এই নাটকেই প্রথম অভিনয় করতে এলেন লিলি চক্রবর্তী। লিলি চক্রবর্তীর বাবার চরিত্রে ছিলেন ছবি বিশ্বাস। চরিত্রের নাম সাধন চৌধুরী।
শিশির কুমার ভাদুড়ির কাছে অভিনয় শিক্ষালাভের সুযোগ ছবি বিশ্বাসের কোনওদিন ঘটেনি। তবে নিজেকে তিনি শিশির কুমারের একলব্য শিষ্যরূপে উল্লেখ করতেন। শ্রীরঙ্গম মঞ্চে (পরে যেটির নাম হয় বিশ্বরূপা থিয়েটার, যার ঠিকানা ২বি, রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট, কলিকাতা-৬) শিশির কুমারের দুর্দিনে প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে সেখানে অভিনয় করবার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন ছবি বিশ্বাস, অন্যত্র মোটা টাকার প্রস্তাব ছেড়ে দিয়ে। এই মঞ্চেই শিশিরকুমারের সঙ্গে ‘আলমগির’ নাটকে ‘রাজ সিংহ’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি’ তাঁকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান দেয়, ১৯৫৯ সালে। কলকাতার বিভিন্ন পেশাদারি মঞ্চেও একটানা ১৯৩৮ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অভিনয় করেন। স্বাস্থ্যের কারণে মঞ্চাভিনয় থেকে তিনি বিরত থাকেন। পরে আবার স্টার থিয়েটারে যোগ দেন ১৯৫৯ সালে ‘ডাকবাংলো’ নাটকের মধ্য দিয়ে। ‘দুই পুরুষ’ নাটকে নুটুবিহারী তাঁর এক স্মরণীয় নাট্যাভিনয়। সপরিবারে দেশের বাড়িতে যাবার পথে এক মোটর দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয় (১৯৬২ সালের ১১ জুন)। পরে স্টার থিয়েটারে এক স্মরণ সন্ধ্যায় ‘দুই পুরুষ’-এর লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলিতে অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি ছবি বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেননি শুধু, এসেছেন নুটুবিহারীকে শ্রদ্ধা জানাতে। লেখকের দৃষ্টিতে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ও শিল্পী একাকার হয়ে গেছেন।