বিদ্যার্থীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। অতিরিক্ত চিন্তার জন্য উচ্চ ... বিশদ
এই উৎসবের সূত্রপাত হয় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর (১৭১৭-১৭২৭) আমলে। তারপর থেকে আজও এই উৎসব চলে আসছে। এই উৎসব হয় মূলত খাজা খিজিরের উদ্দেশে। এক সময় অবশ্য এই উৎসবের আরও রমরমা ছিল। নিখিলনাথ রায়ের ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় সেই সময় উৎসবের আগের দিন নবাবপ্রাসাদের এক বিরাট দরবারের অধিবেশন হতো। দেশীয় ও ইউরোপীয় বহু সম্ভ্রান্ত মানুষ সেখানে উপস্থিত থাকতেন। বাংলা, বিহার, ওড়িশার নাজিমরা উপস্থিত থাকতেন। তখন আতসবাজির প্রচণ্ড ধূম ছিল। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রোশনিবাগে বিশাল আলোকগৃহ নির্মাণ করা হতো। মুর্শিদাবাদ কাহিনী গ্রন্থে লেখা রয়েছে, ‘যখন এই উৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হইত, উক্ত যানের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ৩০০ হস্ত ও প্রস্থে ১৫০ হস্ত ছিল। বর্তমান সময় দৈর্ঘ্যে ৮০ হস্ত ও প্রস্থে ৫০/৬০ হস্তমাত্র হয়। কদলীবৃক্ষ সকল জলে ভাসাইয়া, তদুপরি বংশের দ্বারা নানাবিধ গৃহ, দ্বিতল, ত্রিতল অট্টালিকা, রণতরী প্রভৃতি নির্মিত এবং নানা বর্ণের কাগজ দ্বারা মণ্ডিত করিয়া, অগণ্য আলোক প্রজ্জ্বলিত করা হয়। মুর্শিদাবাদের উত্তরাংশে জাফরাগঞ্জে উক্ত আলোকযান নির্মিত হইয়া থাকে। রাত্রি হইলে, মতিমহাল দেউড়ি হইতে এক বৃহৎ জৌলুস জাফরাগঞ্জাভিমুখে অগ্রসর হয়। সুসজ্জিত হস্তী, অশ্ব, উষ্ট্র, অশ্বারোহী ও পদাতিকগণ সেই জৌলুসের সহিত গমন করে। স্বর্ণরৌপ্যমণ্ডিত নানাবিধ যান ধীরে ধীরে চলিতে থাকে।’
এই জৌলুসে অবশ্য এখন ভাটা পড়েছে। এখন এই রাজকীয় জৌলুস হয়তো দেখা যায় না। তবে এখনও যেটুকু হয়, তাই অত্যন্ত দর্শনীয়। দূর-দূরান্ত থেকে অজস্র দর্শনার্থী এদিন ভিড় করেন এই উৎসবের টানে।
এই উৎসবটি মূলত হয় রাতে। ভাগীরথীর বুকে। উৎসবের কয়েকদিন আগে থেকেই তৈরি করা হয় বাঁশের বাখারি, কাঠের টুকরো প্রভৃতি দিয়ে এক বিরাট বজরা। এই বজরাকে সাজানো হয় বিভিন্ন রঙিন ও ঝলমলে কাগজ ইত্যাদি দিয়ে। বজরাটি সম্পূর্ণ সাজানো হয় প্রদীপ ও বিভিন্নরকম শব্দহীন আতসবাজি দিয়ে।
অনুষ্ঠানের দিন বিকালে মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব সেই আমলের নবাবি পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে ঘোড়ায় চড়ে ব্যান্ডপার্টিসহ উপস্থিত হন হাজারদুয়ারি সংলগ্ন ভাগীরথীর ঘাটে। সেই ঘাটে আগেই কলাগাছের ভেলার ওপর বজরাটিকে এনে সাজানো হয়। এবার বজরায় শেহরা (মালা) এবং প্রদীপ জ্বালার পালা। প্রথমে এই দায়িত্ব পালন করেন নবাব সাহেব। তারপর উপস্থিত অতিথিদের পালা। প্রথমে সোনার প্রদীপ, তারপর রুপোর, এভাবেই প্রদীপ জ্বালানো হয়। এরপর নবাব যে দড়ি বা বেড়া দিয়ে ভেলাটি বাঁধা থাকে সেটি কেটে দেন। অর্থাৎ বেড়া কাটেন এবং বজরায় সাজানো আতসবাজি একটি জ্বেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ভাগীরথীর দুই তীর থেকে পোড়ানো বিভিন্নরকমের আতসবাজি। স্রোতের টানে বজরাসুদ্ধু ভেলা ভেসে চলে। সমগ্র বজরায় জলে জ্বলতে থাকে বাতি আর আতসবাজি। বজরার পেছন পেছন নৌকায় থাকে ব্যান্ডপার্টি। তাঁরা একের পর এক বাজিয়ে চলেন বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান। মধ্যরাতে, নদীর বুকে সে এক অপূর্ব দৃশ্য। একদিকে জ্বলতে জ্বলতে এগিয়ে চলেছে বজরা, অন্যদিকে আতসবাজির রোশনাইয়ে রাতের আকাশ আলোকিত, আর তারই সঙ্গে ব্যান্ডে বাজছে ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’ অথবা ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্থান হামারা’। তখন যেন ভুলে যেতে হয় জীবনের বাকি সব পাওয়া না পাওয়ার কথা। এই উৎসব সম্পর্কে বলা হয় এ হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসব। এখানে কোনও ধর্মের ভেদাভেদ নেই। তাই ব্যান্ডে কোনও ধর্মীয় সঙ্গীত নয়, বাজানো হয় শুধুই দেশাত্মবোধক গান।
এক সময় জ্বলতে জ্বলতে বজরাটির আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ব্যস! এখানেই উৎসবের শেষ।
প্রসঙ্গত যেহেতু এই উৎসবটি হয় রাতে এবং হাজারদুয়ারির কাছে ভাগীরথীর ঘাটে। কাজেই যাঁরা হোটেলে থেকেই এই উৎসব দেখতে চান, তাঁদের উচিত হবে হাজারদুয়ারির কাছে ভাগীরথীর পাশের হোটেলে থাকা। আর একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য। এই উৎসব হয় ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। এ বছর এটি হবে আগামী ১২ সেপ্টেম্বর (বাংলার ২৫ ভাদ্র)।
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী