প্রণয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে। কারও কথায় মর্মাহত হতে হবে। ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কর্মে সুনাম ... বিশদ
বাগরাকোটের পথে ঢুকল গাড়ি। এ পথের ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। প্রাচীন সিল্ক রুটের সঙ্গে একদা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সংযোগ স্থাপন করেছিল এই পথ। কবেকার সেই ইতিহাসের গন্ধ মেখে, মিলিটারি হেড কোয়ার্টার পিছনে ফেলে জঙ্গলে প্রবেশ। এরপর অনেকটা চড়াই। ওপর থেকে লীস নদীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। একদিকে পাহাড়, একদিকে খাদ। সেখানে নদী ও উপত্যকা। আদতে লীস ও ঘিস নদীর মধ্যবর্তী উপত্যকায় চুইখিমের অবস্থান। রাস্তা উঠেছে ঘুরে ঘুরে। প্রায় একঘণ্টার পাহাড়ি পথের দু’ধারে শুকনো পাতার আলপনা। শীত যাই যাই সময় পাতারা ওড়ে, পাতারা ঝরে। আকাশ ঝকঝকে। চারপাশে পাহাড়ের বেষ্টনী। মাঝে শান্ত, নির্জন, কুমারী সৌন্দর্য নিয়ে পর্যটকের অপেক্ষায় চুইখিম।
হোমস্টে-র নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চা-পান। উঠোনে প্রচুর মরশুমি ফুলের সঙ্গে প্রজাপতির খেলা। সামনেই অনেকটা উঁচুতে এক ভিউ পয়েন্ট। দুর্দান্ত ল্যান্ডস্কেপ যেন এঁকেছেন স্বয়ং ঈশ্বর। এই অবকাশে চুইখিম সম্বন্ধে কিছু তথ্য। জেলা কালিম্পং। উচ্চতা ৩ হাজার ৫০০ ফুট। মূলত নেপালি ভাষী লোকজনের বাস। বেশির ভাগই কৃষিজীবী। মজুরের কাজও করেন কেউ কেউ। সেনা, পুলিস ও বন বিভাগে আছেন মুষ্টিমেয়। আজকাল হোমস্টে ব্যবসাতেও আসছেন অনেকে। দারিদ্র নিত্যসঙ্গী। তবে ক্ষোভ বা আক্ষেপ কম। দিনরাত লড়াই করে হাসিমুখে বেঁচে আছে। একটি হেল্থ সেন্টারের বড্ড প্রয়োজন বলছিলেন গ্রামের তরুণ ড্রাইভার কিরণ। রোগব্যাধির ক্ষেত্রে বড়ই অসহায় এখানকার মানুষ।
সরল খাওয়াদাওয়া। ভাত, রুটি, ডাল, সব্জি, ডিম, চিকেন। মাছ পাওয়া যায় না। মাছ খেতে চাইলে ওদলাবাড়ির বাজার থেকে নিতে হয়। রাই শাক, স্কোয়াশের তরকারি, ডাল, আলু ভাজা আর চিকেন সহযোগে লাঞ্চ হল। এদের রান্নায় মশলাপাতি কম। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ হয় বলে শাকসব্জির স্বাদ অপূর্ব।
সূর্য পশ্চিমমুখী হওয়ার পরেও বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে ঝলমলে রোদ্দুর থাকে। বাতাসে মিঠে ঠান্ডা। যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। ব্যস্ত পথ চলা গ্রামের মানুষ উঁকি মেরে দেখে যায়, কে এল অতিথি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এখানকার জীবনের গতিপ্রকৃতি। সেই হিসেবেই অস্তগামী সূর্যের কিরণরেখা ধরে ঘরে ফেরে মাঠচড়া গোরুর পাল। কুলায় ফেরা পাখির কলকাকলি মুখরিত করে তোলে আশপাশের গাছগাছালি। এখানে একটা মজার ব্যাপার হল, কারও বাড়িতে কোনও বাউন্ডারি নেই। পায়ে চলা পথ কোথায় কখন যে বাড়ির উঠোন হয়ে আবার পথে পরিণত হবে কেউ জানে না।
দু’দিনের এই সফর পুরোপুরি আলস্যে কাটানোর জন্য আদর্শ। সেই অনুষঙ্গেই চা আর পকোড়া সহযোগে সন্ধ্যা নামে দ্রুত। পাহাড়ের মানুষ মূলত সরল ও আন্তরিক। নাচ-গান খুব ভালোবাসে। ওটা ওদের সহজাত। মানুষকে কত সহজে আপন করে নেওয়া যায়, সেটা এখানে না এলে অনুভবই করতে পারতাম না। ডিনারে রুটি, বেগুন পোড়া আর ডিম কারি। গরম গরম খেয়ে রাত ন’টার মধ্যে বিছানায়। এত তাড়াতাড়ি ঘুম? অসম্ভব। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। শুক্লপক্ষের শেষ। এক-দু’দিন পরেই মনে হয় পূর্ণিমা। জোছনার মায়াময় আলো ছড়িয়ে সর্বত্র। ছোট ছোট গ্রাম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। বাড়িগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলেও, রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো নেই। ফলে আরও সুন্দর প্রতিভাত আকাশের আলো। মুগ্ধতার আবেশ চোখে মেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন অনেক ভোরে পাখিরাই ডেকে-হেঁকে জাগিয়ে দেয়। জানলা দিয়ে ভোরের নরম আলো সবে উঁকি মারতে শুরু করেছে। আহা, একেই বলে প্রাণের আরাম, মনের শান্তি। গরম গরম পুরি-সব্জি দিয়ে ব্রেকফাস্ট। বেড়াতে যাব ঠিক ছিল। কিরণের গাড়িতে প্রথমে চুইখিম মাইন জুনিয়র হাইস্কুল, সেখান থেকে চারকোল। ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। ওখানেই এক হোমস্টে-তে লাঞ্চ করলাম। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ চমৎকার।
চারকোল থেকে ফিরতে বিকেল শেষ। সবাই কিছুটা ক্লান্ত। অতএব চা না পাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম। গ্রাম এখন শান্ত। কুয়াশা থাকায় কিছুটা যেন রহস্যঘন পরিবেশ। ডিনারে রুটি আর চিকেন কষা খেয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ি সবাই। দূরে কোথাও গোরুর ডাক শোনা যায়। বাছুরকে ডাকছে মা। এখানকার জঙ্গলে লেপার্ড আছে শুনেছি। মা-গোরুর আশঙ্কা স্বাভাবিক। একটু পর সব চুপচাপ। বাছুরটা ঘরে ফিরেছে নিশ্চয়ই। পরদিন রাতে কলকাতা ফেরার ট্রেন। শেষ কয়েক প্রহর শান্ত, নির্জন, মগ্ন চুইখিমের সঙ্গে। আবহে ঝিঁঝিদের কনসার্ট আর রাতচরা পাখিদের গান। ভালো থেকো চুইখিম।
জরুরি তথ্য
শিলিগুড়ি থেকে চুইখিম পৌঁছতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে।
ছোট গাড়ি যায় না। গাড়িভাড়া নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন/শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড থেকে একপিঠ কমবেশি ২ হাজার ৫০০ টাকা। এয়ারপোর্ট থেকে সামান্য বেশি। টিম করে গেলে সুবিধা। হোমস্টে-র খরচ থাকাখাওয়া দিনপ্রতি জনপ্রতি ১০০০ - ১২০০ টাকা। বর্ষা বাদ দিয়ে যে কোনও সময় যেতে পারেন। শীতে পর্যাপ্ত শীত পোশাক চাই। প্রত্যন্ত অঞ্চল। দোকানপাট নেই। তাই অবশ্যই সঙ্গে রাখুন প্রয়োজনীয় ওষুধ, ফার্স্ট এড বক্স, বিস্কুট ও কিছু শুকনো খাবার, টি ও কফি ব্যাগ, জল গরমের কেটলি, টর্চ ও মোমবাতি-দেশলাই। কাছাকাছি যেতে পারেন চারকোল, পাবুং। এছাড়া ডুয়ার্সও যাওয়া যেতে পারে এখান থেকে। বেশ কয়েকটি হোমস্টে আছে চুইখিমে। আগাম বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করুন হেল্প ট্যুরিজম।
টোল ফ্রি নম্বর: 18001230156
ফোন: (0353) 2433683/2535896