কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
অনন্যার মন ভালো নেই। সারাক্ষণই এক দ্বন্দ্ব কাজ করছে তাঁর মনে। বাড়িতে থাকলে মনে হয় অফিসের কাজে ক্ষতি হচ্ছে, আর অফিসে বেরলেই বাড়ির জন্য মনটা ছটফট করতে থাকে। ছেলেকে পড়ানো হচ্ছে না ঠিকমতো, স্বামীর দেখভালে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এমনকী বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি কারও দিকেই সঠিক নজর দেওয়া হচ্ছে না বলে মনে মনে নিজেকেই দোষ দিতে থাকে অনন্যা। আর এই দ্বন্দ্বই ক্রমশ মানসিক চাপে পরিণত হচ্ছে। শুধু অনন্যাই নয়, কর্মরত মহিলারা অনেকেই এমন অশান্তির তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সারাক্ষণই তাদের মনে হয় ঘরে বাইরে কোথাও ঠিকমতো সময় দিয়ে উঠতে পারছেন না। তাহলে উপায়? কর্মরত মহিলাদের মানসিক শান্তির খোঁজ দিচ্ছেন প্রজাপিতা ব্রহ্মাকুমারী আশ্রমের অধ্যক্ষা সিস্টার অস্মিতা।
মোকাবিলা করুন ধীরেসুস্থে
মানসিক চাপের মোকাবিলার আগে তার কারণটা জানা দরকার, বললেন সিস্টার অস্মিতা। তাঁর কথায়, ‘মানসিক চাপ বা স্ট্রেস সাধারণত হয় ব্যালান্সের অভাব থেকে। অনেক সময়ই মহিলারা ঘরের সঙ্গে বাইরের জগৎকে সঠিকভাবে ব্যালান্স তৈরি করতে পারেন না। আর তখনই সব কাজ তালগোল পাকিয়ে যায়।’ সিস্টার অস্মিতার মতে, আমরা এই ব্যালান্স তৈরি করতে গিয়ে অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে ফেলি। তাতে মনের মধ্যে কাজের যে ধারাটা পরিকল্পিত থাকে, তা আরও গুলিয়ে যায়। আমরা কাজের খেই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু ধীরেসুস্থে কাজ করতে গেলে দেখবেন সব কাজই নিয়ম মতো হচ্ছে। ফলে তাড়াহুড়ো করবেন না। উপযুক্ত সময় নিয়ে কাজ করুন। তাতে ব্যালান্সও থাকবে, আবার সব কাজই ভালোভাবে করা যাবে। প্রতিদিন কী কী করবেন, তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে নেওয়া দরকার। আর তার জন্য কর্মরত মহিলাদের উচিত একটা রুটিন বানিয়ে সেটা মেনে চলা। সিস্টার অস্মিতা কিন্তু বলেন, স্ট্রেস বা চাপ যে সবসময়ই খারাপ তা নয়। এর সামান্য কিছু ভালো দিকও আছে। অনেক সময় চাপের মুখে আমরা দারুণ কাজ করি। কিন্তু এই চাপ যদি দীর্ঘদিন চলে, তাহলে তা শরীরের ক্ষতি করে। ফলে তা যে কোনও পরিস্থিতিতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
নিজের জন্য সময় রাখুন
সিস্টার অস্মিতা মনে করেন, জীবনে একটা নিয়ম থাকা খুবই দরকার। না হলে কোনও ছন্দ থাকে না। কেমন সেই নিয়ম? তাঁর বক্তব্য, কর্মরত মহিলারা যদি রোজ ঘুম থেকে ওঠার এবং রাতে শুতে যাওয়ার সময়টা মোটামুটি নির্দিষ্ট করতে পারেন তাহলেই অনেকটা কাজ হবে। অর্থাৎ দিন শুরু হওয়ার কিছুটা আগে ঘুম থেকে উঠুন। সেই সময়টা কিন্তু কাজ এগিয়ে রাখার জন্য নয়, বরং নিজেকে সময় দেওয়ার জন্য। দিনের কর্মসূচি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার জন্য। কোন কাজে কতটা সময় দেবেন, সেটা যদি একান্তে ভেবে রাখতে পারেন, তাহলে দেখবেন দিনটা আর তাড়াহুড়ো করে অগোছালোভাবে কাটছে না। এই সময়ের খানিক অংশ মেডিটেশন বা ধ্যান করেও কাটাতে পারেন। দিনের শুরুতে ধ্যান করলে সারাদিন মন শান্ত থাকবে। একইভাবে রাতেও কিছুটা সময় রাখুন শুধুই নিজের জন্য। সেই সময় সারাদিনে কী কী করলেন, কোন কাজটা বাকি থেকে গেল বা আর কীভাবে কাজ করলে সবটা একসঙ্গে সামলানো যাবে সেটা ভেবে নিতে পারেন।
সারাটা দিন অনেক কাজের মধ্যে দিয়ে কাটে বলে আমরা নিজেদের সময় দিতে ভুলে যাই। এটা বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি ঘটে। ফলে দিনের শেষে কিছুটা সময় ভাবনাচিন্তার জন্য, নিজের কথা ভাবার জন্য রাখা খুবই জরুরি।
অপরাধবোধে ভুগবেন না
মহিলারা সবসময় সবার শেষে নিজেকে স্থান দেন। এই মানসিকতার জন্যই কর্মরত মহিলাদের মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করে। তাঁদের মনে হয়, কাজের জগৎটা বুঝি তাঁর একান্ত নিজের। ফলে সেখানে সময় কাটানো মানেই পরিবারকে বা সন্তানকে অবহেলা করা। প্রথমেই মহিলাদের এই অপরাধবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, বললেন সিস্টার অস্মিতা। তাঁর মতে একটাই জীবন, সেটা কেমন ভাবে যাপন করবেন, তা নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। জীবনে সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। মহিলাদের বুঝতে হবে তাঁরা শুধুই নিজেদের জন্য চাকরি করেন না, বরং বাড়ির অন্য সদস্যদেরও ভালো রাখার জন্য রোজগার করেন। তাছাড়া চাকরির কিছুটা সময় যদি একজন মহিলা মন ভালো রাখার খোরাক পান, তাহলে পরিবারের জন্য তো তা ভালোই। বাড়ির গৃহিণী খুশি থাকলে তাঁর পরিবারও সুখেই থাকবে, এতে আর সন্দেহ কী? তাছাড়া কর্মরত মহিলাদের বাচ্চারাও নিজেদের মতো বড় হয়ে ওঠে, স্বাবলম্বী হতে শেখে, নিজস্ব ভাবনাচিন্তা তৈরি করে নিতে পারে— এগুলো সবই কিন্তু তাদের জন্য ভালো।
কোয়ালিটি টাইম
কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা খুবই প্রয়োজন। কোয়ালিটি টাইম আখেরে কোয়ান্টিটি টাইমের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর। যে মা চাকরি করেন এবং দিনের অনেকটা সময় সন্তানের সঙ্গে থাকেন না, তাঁদের উচিত সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া। ফোকাসড অ্যাটেনশন দেওয়া। অর্থাৎ যখন বাচ্চার সঙ্গে কাটাবেন, তখন বাকি আর কিছু ভাববেন না। সেই সময়টুকু শুধুই আপনার সন্তান আর আপনি। অনেক মহিলা কিন্তু এই সময়েও ফাঁকি দেন। আর তখনই অপরাধবোধ, মানসিক চাপ ইত্যাদি জন্ম নেয়। সময় যখন অফুরান নয়, তখন অন্তত যেটুকু আছে সেটুকুই সম্পূর্ণ দিন। আর সন্তানকে সময় দেওয়া মানে শুধু তাকে পড়ানো বা কাজের কথা বলা নয়, তার সঙ্গে খেলুন, গল্প করুন, তার মনের কথা জানুন। তার বক্তব্য শুনুন, তাকে বুঝুন। দেখবেন নিজের মনেই একটা প্রশান্তিবোধ হবে।
পজিটিভ ভাবনা
ইতিবাচক চিন্তা বা পজিটিভ থিঙ্কিং মন ভালো রাখার জন্য খুবই জরুরি। অবসর সময় আমরা অনেক ক্ষেত্রেই টিভি দেখে কাটাই, কিন্তু অবসরের খানিকটা সময়ও যদি স্পিরিচুয়াল স্পিকারদের কথা শোনা যায়, তাহলে কিন্তু মন ভালো থাকে। সিস্টার অস্মিতা জানালেন ইতিবাচক চিন্তা করলে, স্পিরিচুয়াল লিডারদের কথা শুনলে মানসিক স্থিতি আসে। যার ফলে আমাদের মনে এবং কাজের মধ্যেও একটা পজিটিভ এনার্জির সঞ্চার হয়। আমাদের মন প্রশান্ত ও চাপমুক্ত থাকে। মনে ইতিবাচক চিন্তার সঞ্চার হলে অযথা পরনিন্দা-পরচর্চা করে সময় কাটাতে হয় না। অনেকেই গসিপ করেন, বোঝেন না এই গসিপের মাধ্যমে আমাদের মনে নেতিবাচক ভাবনার উদয় হয়। পরবর্তীতে এই ধরনের ভাবনাই মনকে ভারাক্রান্ত করে এবং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
পছন্দটা ভুলবেন না
নিজের পছন্দগুলো জলাঞ্জলি দেবেন না। ভালো লাগার কদর করুন। মন খারাপ হলে, মানসিক চাপ থাকলে সেই পছন্দের জিনিসগুলোই আপনার মন ভালো করে আপনাকে চাপমুক্ত করতে সাহায্য করবে। ধরুন, আপনি হয়তো কুকুর বা বেড়াল বা পাখি ভালোবাসেন। তাহলে মানসিক চাপ কাটাতে নিজের পোষ্যটির সঙ্গে সময় কাটান। অনেকেই গান ভালোবাসেন, মানসিক চাপমুক্ত হতে গান শুনুন। নাচতে ভালো লাগলে তাই করুন। কেউ ছবি আঁকতে ভালোবাসেন, কেউ বা টুকটাক হাতের কাজ করতে চান, এগুলো সবই কিন্তু মানসিক চাপ কাটাতে আপনাকে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন আনন্দই সবচেয়ে বড় স্ট্রেস রিলিভার। আনন্দে থাকলে এনার্জি আপনি আসে। অতএব ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন। মানসিক দ্বিধা, দ্বন্দ্ব সব কেটে যাবে।