কর্মলাভের যোগ আছে। ব্যবসায় যুক্ত হওয়া যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রশংসা জুটবে। ... বিশদ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম বুঝেছিলেন সেনাবাহিনীতে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। তবে তার জন্য চাই উপযুক্ত শিক্ষা আর সুযোগ। এই দু’টি পেলে তাঁরাও সেনাবাহিনীতে যোগদান করে অস্ত্র হাতে দেশের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারেন। কিন্তু সে যুগে সমাজই ছিল মহিলাদের ক্ষেত্রে বিরূপ। মেয়েদের দুর্বল আর অবলা বলে সমাজের মূল স্রোত থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। বঞ্চিত করা হতো। কিন্তু নেতাজি ভাবলেন, অনেক হয়েছে আর নয়। তাই ১৯৪২ সালে গঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদানের কথা ঘোষণা করলেন। তাঁদের স্বাগত জানালেন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে। বললেন, পুরুষ সেনাদের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদেরও হাতে তুলে নিতে হবে বন্দুক রাইফেল। সুদূর সিঙ্গাপুরে বসে নেতাজি ১৯৪৩ সালে মহিলাদের নিয়ে ‘রানি ঝাঁসি রেজিমেন্ট’ গঠন করলেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাকে অন্যমাত্রা দিলেন। আরও শক্তিশালী করে তুললেন নিজের স্বপ্ন দিয়ে গড়া সেই মহিলা ব্রিগেডকে। আমরা জানি ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় মহিলা নেত্রী হিসেবে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈয়ের বীরত্বের কথা। তাই নেতাজিও তাঁর নারী বাহিনীর নাম রেখেছিলেন ঝাঁসির রানি বাহিনী। এর নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন ওরফে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল (১৯১৪-২০১২)। আমরা সবাই তাঁকে এই নামেই জানি। দক্ষিণ ভারতের এই মহিলা পেশায় ছিলেন চিকিৎসক ও আদর্শে বামপন্থী। পরে সুভাষচন্দ্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন। ক্রমশ লক্ষ্মী সায়গলের কাজে মুগ্ধ হয়ে নেতাজি তাঁর হাতেই তুলে দেন ঝাঁসির রানি বাহিনীর নেতৃত্ব। ইউরোপ থেকে ফিরে ১৯৪৩ সালের ২ জুলাই নেতাজি সিঙ্গাপুরের মাটিতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিলেন নারী বাহিনীর সবাই। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীর ভাষায়, ‘অ্যাজ ইফ চার্জড উইথ ইলেকট্রিসিটি।’ শুধুমাত্র মেয়েদের নিয়ে আস্ত একটি রেজিমেন্ট তৈরি করার কথা এর আগে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। কমব্যাট্যান্ট হিসেবে তাঁদের ট্রেনিং দেওয়ার কথা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না। সেই অকল্পনীয় ধারণাকেই বাস্তবে পরিণত করেন নেতাজি। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী একবার বলেছিলেন, ‘আমার নামের (লক্ষ্মী) গুরুত্ব যে কতখানি প্রসারিত তা নেতাজির সান্নিধ্যে না এলে হয়তো কখনও বুঝতেই পারতাম না। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈয়ের সঙ্গে আমার নামটা জুড়ে দিয়ে নেতাজি যখন ঝাঁসি রেজিমেন্ট শুরু করলেন তখন উপলব্ধি করেছিলাম ‘লক্ষ্মী’ নামটার গুরুত্ব। এই নামটার সঙ্গেই বোধহয় মন্ত্রের মতো জড়িয়ে আছে লড়াইয়ের ইতিহাস। রানি লক্ষ্মীবাঈ হাসিমুখে জীবনের পরোয়া না করেই ঝাঁসিকে ইংরেজের কবল থেকে বাঁচাতে আত্মবলিদান দিয়েছেন। একইভাবে নেতাজি ভারতের জন্য আমাদের লড়াই করার আহ্বান করেছিলেন। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা অসম্ভব।’ ঝাঁসি রেজিমেন্টে আরও যাঁদের নাম উল্লেখযোগ্য, তাঁরা হলেন কমান্ডার জানকী থেবার্স, লেফটেন্যান্ট আশা সহায় এবং অঞ্জলি ভৌমিক।
১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ । আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল শওকত আলি মালিকের নেতৃত্বে মণিপুরের মৈরাং ও ইম্ফলে প্রথম স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলিত হয়। ব্রিটিশরা পরাজিত হয় সাময়িকভাবে। কমান্ডার জানকী থেবার্স ঝাঁসি বাহিনীর ২৫০ জন রানিকে নিয়ে প্রস্তুত করেছিলেন বিশেষ সুইসাইড স্কোয়াড। নেতাজি সেদিন রেডিও মারফত ঘোষণা করেছিলেন, ‘ঝাঁসি রানি বাহিনীর আমার সশস্ত্র বীরাঙ্গনা ভগিনীগণ... আজাদ হিন্দ ফৌজের দিল্লী চলো স্লোগানের সঙ্গে আর একটি স্লোগান যুক্ত হোক— রক্ত, আরো রক্ত; ব্লাড, মোর ব্লাড। এর অর্থ ৪০ কোটি ভারতবাসীর মুক্তির জন্য আমাদের আরো নিঃশর্ত দান।’ লেফটেন্যান্ট আশা সহায় ও অঞ্জলি ভৌমিক যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহিদ হন। প্রায় ৫০০ নারী সৈন্য সম্মিলিত এই বিশাল মহিলা ব্রিগেড ভারতের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন।
আজ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মেয়েরা যোগদান করছেন, স্থল-আকাশ-জল তিন ক্ষেত্রেই তাঁরা আছেন। তাঁদের অনুপ্রেরণার জন্য নেতাজির ঝাঁসি বাহিনী নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তস্বরূপ। স্বাধীন ভারতে মেয়েরা আজ অনেক ক্ষেত্রেই ‘স্বাধীন’। পছন্দের পেশা গ্রহণে বাধা নেই তাঁদের। তাই সামরিক বাহিনীতে মেয়েরা বেশি করে যুক্ত হতে পারছেন। গত বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের শীর্ষ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে ঘোষণা করে যে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও সেনাবাহিনীতে সম পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হবেন। প্রসঙ্গত ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ইতিমধ্যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মেজর গারট্রুড আলি রাম, প্যারাট্রুপার রুচি শর্মা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিতালি মধুমিতা, ক্যাপ্টেন স্বাতী রাভালের মতো ব্যক্তিত্ব।