অতূণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা: পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল মৃৎশিল্পীর দল উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে এসে জীবন শুরু করছিলেন স্বাধীনতার পরেই। এখানেই জীবিকা ও বসবাস। পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ফরিদপুর থেকে পাল পদবিধারী এই মৃৎশিল্পীরা নিজেদের শিল্প নৈপুণ্যে ধীরে ধীরে কুমোরটুলিতে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। এখানকার ছোট্ট পরিসরে সেই শিল্পীরা গড়ে তুলেছিলেন ‘স্টুডিও’, যা তাঁদের কাছে ‘গোলা’ নামেই পরিচিত। প্রতিমা তৈরির পাশাপশি এই অঞ্চলেই তাঁদের বসতি। জীবিকার কারণে শরতের দুর্গাপূজায় তাঁরা অংশ নিতে পারতেন না। শিল্পী পরিবারের মহিলা ও শিশুরা শারদীয়া পুজোর আনন্দ থেকে দূরেই থেকে যেতো। রাখাল পাল, নেপাল পাল, গোরাচাঁদ পাল, কার্তিক পাল সহ পূর্ববঙ্গীয় দশ-বারোটি শিল্পী পরিবার তখনই ঠিক করেন, তাঁরা বাসন্তীদুর্গা পূজা শুরু করবেন। এই বাসন্তীদুর্গা পূজা শিল্পী পরিবারগুলির বৎসরিক মিলন উত্সব, সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকার আনন্দমেলা। ৭২ বছর আগে শুরু হওয়া এই পুজোর আকর্ষণ আজও একইরকম রয়েছে বর্তমান প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে। যদিও এই বছর দেশে করোনা নিয়ে তৈরি হওয়া পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কুমোরটুলি মৃৎশিল্পী সমিতির বাসন্তীদুর্গা পুজো। প্রতিবছর নিজেদের মধ্যে থেকে একজন শিল্পী বিনা পারিশ্রমিকে এই দুর্গা মূর্তি বানিয়ে দেন। এ’বছর রাখাল পালের পুত্র নারায়ণ পালের উপর ছিলো প্রতিমা তৈরির দ্বায়িত্ব। নিয়ম মতো শুরুও হয়েছিল প্রতিমা গড়ার কাজ। কিন্তু দেশজুড়ে লকডাউনের জন্য তা থমকে গিয়েছে। হতাশ শিল্পী তাই বলছিলেন, এইভাবে অর্ধেক বানানো মূর্তি পূজো না করে গোলাতেই রেখে দিতে হবে, তা কোনোওদিন ভাবিনি। প্রখ্যাত শিল্পী মোহনবাঁশির পুত্র তপনরুদ্র পাল বলছিলেন, প্রথমে আমরা পুরো পুজো বন্ধ না রেখে ঘট পুজো করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাও করা সম্ভব হচেছ না। দুর্গাপুজোর সমস্ত উপকরণ, ফল, ফুল জোগান দেওয়া কঠিন। দমদম থেকে প্রতিবছর পুরোহিত আসেন পুজো করতে। এই অবস্থায় তিনিও রাজি হচ্ছেন না।
বাসন্তীদুর্গা পুজোর সঙ্গে এখানে অনুষ্ঠিত হয় অন্নপূর্ণা ও চণ্ডী পূজো। নবমীর দিন সারা কুমোরটুলি জুড়ে চলে ভোগ প্রসাদ বিতরণ। কোনো আলাদা মণ্ডপ বা প্যান্ডেলে নয়, কার্তিক পাল ও শ্রীকৃষ্ণ পালের গোলার মধ্যের অস্থায়ী দেয়াল সরিয়েই শুরুর দিন থেকে পুজো হয়ে আসছিল। সেখানে মণ্ডপ তৈরির কাজও শুরু হয়েছিলো। এই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন পরিবাগুলির সবাই। কিন্তু এরপরই সরকার থেকে করোনা রোগ সংক্রমণ রোধ করতে জারি হয়েছে ফরমান। একসঙ্গে অনেকে মিলে এক জায়গায় থাকা চলবে না, রক্ষা করতে হবে সামাজিক দূরত্ব। এদিকে একসঙ্গে অনেকে মিলে কাজ না করলে এতো বড় পুজোর ব্যবস্থাপনা করা যায় না। এখানেই হয়েছে বিপত্তি। প্রচুর মানুষও আসে এই দুর্গাপুজো দেখতে। তাই মন না চাইলেও বর্তমান পরিস্থিতি শিল্পীদের বাধ্য করেছে বাসন্তীদুর্গা পূজা বন্ধ রাখতে। ফলে পঞ্জিকায় বাসন্তী ষষ্ঠি তিথি আসবে, কিন্তু কুমোরটুলিতে শুরু হবে না পুজো। বাজবে না ঢাক, জ্বলবে না রকমারি আলো। তিয়াত্তর বছরের দোরগোড়ায় এসে বাসন্তীদুর্গা পুজোয় অকাল দশমীর বিষাদের ছায়া কলকাতার কুমোরটুলির ‘বংগাল পাড়ায়’। -ফাইল চিত্র