কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
হাতছাড়া করার দুঃসাহস দেখাননি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালার বাসিন্দা মুকাদস আসরাফের বাবা-মা’ও। মেয়েকে একরকম চোখ বুজেই তুলে দিয়েছিলেন চীনের ‘ভালো-সৎ পাত্র’র হাতে। সুখী দাম্পত্যের স্বপ্ন-উড়ানে চেপে স্বামীর ঘরে পাড়ি জমাল ষোড়শী আসরাফ। অতপরঃ মেয়েকে আশীর্বাদ করে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন দীন-দরিদ্র বাবা। তারপর?
সে এক নিদারুণ এক উপাখ্যান! আসরাফের অভিজ্ঞতার ঠাসা কোলাজ। হাড়হিম করা সেই অভিজ্ঞতা! শুধু একা আসরাফ নয়, তার মতো অনেক আসরাফই সংসার বাঁধার স্বপ্ন-উড়ানে চীনে যাচ্ছে। কেউ ফিরছে। কেউ ফিরছে না। নির্যাতন-যন্ত্রণার বারামাস্যাকে বুকে চেপে থেকে যাচ্ছে চীনে। যারা কোনওরকমে ফিরতে পারছে, তারা বলছে, ‘ভুলেও আর চীনের ‘ভালো পাত্রে’র বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ নয়। ওটা আসলে পাকিস্তানের কনে ক্রয়ের জবরদস্ত বিজ্ঞাপন!’
হ্যাঁ, ঠিকই। পাকিস্তানের কনে কিনছে চীনের যুবকরা! অন্তত আসরাফদের অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলছে। মোটা অঙ্কের টাকা পাক-কনে কিনে নিয়ে যাচ্ছে চীনের যুবকরা। এক সন্তান নীতির সৌজন্যে চীনে বিবাহ যোগ্য কন্যার অনুপাত ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাই সে দেশে কনের চাহিদা বাড়ছে। একটা সময় ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়ার কিশোরীদের কদর ছিল চীনে। এখন চীনের নজর বেশি পাকিস্তানে। আঠারোর নীচের কিশোরীরাই চীনা যুবকদের কাছে বেশি পছন্দের। বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের। ব্যাস ওই পর্যন্তই। কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যাচ্ছে সম্পর্ক। বিদেশে তখন সে একা, অসহায়। কলঙ্ক নিয়ে আর নিজের দেশে ফেরে না। চীনেই থেকে যায় যৌন ক্রীতদাসী হয়ে। পাকিস্তানের মানবাধিকার সংগঠনগুলির সূত্রে তেমনটাই খবর।
তবে কলঙ্ক নিয়েই ফিরতে পেরেছিল মুকাদস আসরাফ। ১৬ বছরের কিশোরী। খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের গরিব পরিবারে জন্ম। বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালায়। স্কুলের পাঠ শেষ করার আগেই বিয়ে হয় এক চীনা যুবকের সঙ্গে। কনের খোঁজে ওই যুবক পাকিস্তানে এসেছিলেন। বিয়ের পর পাড়ি দেয় চীনে। সেখানে যাওয়ার পর পাঁচমাসও হয়নি। ফিরে আসে পাকিস্তানে নিজের বাড়িতে। চোখেমুখে একরাশ আতঙ্ক! আসরাফ এখন সন্তানসম্ভবা! তাঁকে নিয়ে এখন চিন্তার অন্ত নেই বাবা-মায়ের। কী এমন হল যে, মাত্র পাঁচমাসের মধ্যেই মুকাদসের দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে খানখান হয়ে গেল? আসরাফের নিজের কথায়, ‘সহ্যসীমার বাইরে চলে গিয়েছিল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা। আর পেরে উঠছিলাম না! তাই কোনওরকমে পাকিস্তানে চলে আসি।’
আসরাফ একটা উদাহরণমাত্র। ‘কনে ক্রয়ের’ বিজ্ঞাপনে প্রতারিত শত শত কিশোরীর প্রতিনিধি সে। তার জীবন-যন্ত্রণার কাহিনি খুঁড়তে গিয়ে উঠে এসেছে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, পাঞ্জাব প্রদেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু খ্রিস্টান পরিবারই চীনের যুবকদের ‘সফট টার্গেট’। তারা কেউ কাজের অছিলায় পাকিস্তানে আসে। কেউ আবার চীন-পাকিস্তান বাণিজ্যিক করিডর নির্মাণের কাজে যুক্ত বলে ‘বিবাহ বন্ধনী’ নামক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নাম লেখায়। এগুলি আসলে ফুঁইফোড় সংস্থা। তারাই কনের খোঁজে বিজ্ঞাপন দেয়। সরাসরি যোগাযোগও করে গরিব পরিবারগুলির সঙ্গে। যোগসূত্র তৈরিতে কাজে লাগানো হয় যাজকদের। বিনিময়ে তাঁরা পান মোটা টাকাও। এমনও অভিযোগও উঠেছে। যাজকদের পাশাপাশি সরকারি আধিকারিকদের একটা বড় অংশ সেই চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ।
এখন প্রশ্ন হল কীভাবে কাজ করে চক্রটি? প্রথমে ইন্টারনেটের মাধ্যমে‘বিবাহ বন্ধনী’ প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করে চীনা যুবকরা। চাহিদা মতো কনের বয়স, উচ্চতা সবকিছু তারা জানিয়ে দেয়। যাজকদের সহযোগিতা নিয়ে চীনা যুবকদের জন্য কনে খুঁজে বেড়ায় সংস্থাগুলি। পছন্দমতো কনে খুঁজে পাওয়া গেলে তার পরিবারের সঙ্গে শুরু হয় প্রাথমিক কথাবার্তা। এবং সঙ্গে সঙ্গেই মোটা অঙ্কের টাকার অফার। যাকে বলা ‘কনে পন’। অর্থাৎ, চীনা যুবকের সঙ্গে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হলে কোনও খরচ লাগবে না। উল্টে ডলার ডলার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব। এমনকী বিয়ের পোশাক সহ আনুসাঙ্গিক ব্যায়ভার বহনেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। গরিব বাবা-মা সেই টোপ গিলে নেয়। বিনিময়ে নিজেদের নাবালিকা, কিশোরী কিংবা যুবতী মেয়েদের চীনা যুবকের হাতে সঁপে দিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্ত হন। সংবাদ সংস্থার তদন্তে উঠে এসেছে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত এক একটি কনের পরিবারের হাতে তুলে দেয় চীনা যুবকরা। সেই সঙ্গে যাজক কিংবা সরকারি আধিকারিকদেরও মোটা টাকা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
পাকিস্তানের কনে-স্মাগলিংয়ের কথা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে পাঞ্জাব সরকারও। পাঞ্জাব প্রদেশের মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু মন্ত্রী ইজাজ আলম বলেছেন, সত্যিই এটা এক ধরণের ‘মানব পাচার’। আমি এ ধরনের বেশ কয়েকটি গরিব পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, স্রেফ অর্থের লোভে তাঁদের কন্যাকে চীনা যুবকের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা না ভেবে তাঁরা এ কাজ করছেন।’ এরই পাশাপাশি আলমের অভিযোগ, পাকিস্তানে অবস্থিত চীনের দূতাবাস এ সবকিছু জেনেও চোখে ঢুলি পড়ে রয়েছে। প্রশ্নাতীতভাবে ভিসার ছাড়পত্রও দিয়ে দিচ্ছে। যা শুনে চীনের বিদেশমন্ত্রক কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছে, চীন এই ধরনের বেআইনি বিবাহ ব্যবস্থাকে মদত দেয় না। ফুঁইফোড় বিবাহ সংস্থাগুলির কাজকর্মের সঙ্গে কোনও আপোসও করে না।
দু’দেশের এই চাপানউতোরের মাঝেই সম্প্রতি পাঞ্জাব প্রদেশে একটি অভিযান চালায় ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ)। সেই অভিযানে চীনের আটজন নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগে ধরা হয় চারজন পাক নাগরিককেও। এফআইএ সূত্রের খবর, ধৃতরা সকলেই কনে পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত।