বালুচিস্তানের লড়াই ও সুভাষচন্দ্র
হিমালয়ের কোনও গোপন গিরিখাতে বসানো ট্রান্সমিটার যন্ত্র। খাঁজকাটা পাথুরে ভূমিতে প্রোথিত ত্রিবর্ণ পতাকা। ক্রমান্বয়ে লাল, হলুদ, সবুজ রং। মধ্যিখানে কাটাকুটিতে রাখা দু’টি হাতলওয়ালা তরোয়াল।

বর্তমান ওয়েবডেস্ক
মে ১৮, ২০২৫
সৈকত নিয়োগী: হিমালয়ের কোনও গোপন গিরিখাতে বসানো ট্রান্সমিটার যন্ত্র। খাঁজকাটা পাথুরে ভূমিতে প্রোথিত ত্রিবর্ণ পতাকা। ক্রমান্বয়ে লাল, হলুদ, সবুজ রং। মধ্যিখানে কাটাকুটিতে রাখা দু’টি হাতলওয়ালা তরোয়াল। বিচিত্র এই নিশানেই বিপ্লবের অঙ্গীকার। ‘গদর’! সূর্য অস্ত যাচ্ছে। হু হু করে বইছে হিমেল হাওয়া। ঝড়ের পূর্বাভাসে আসন্ন দুর্বার সময়ের প্রতীকী ঘোষণা যেন। ১২ মার্চ, ১৯৪১। রাত্রি আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। খস খস করে লোকটা হিজিবিজি কেটে চলেছে। কোড ওয়ার্ড! পাশে রাখা সচল গ্রামোফোন রেকর্ডে যান্ত্রিক শব্দ। হঠাৎ স্তব্ধ সবকিছু! রেকর্ড বেজে উঠল...
‘প্রিয় বন্ধুরা! স্বাধীন ভারতবর্ষ দীর্ঘজীবী হোক!
স্যার সিকন্দরের পেয়াদারা আমার খোঁজ চালাচ্ছে তন্ন তন্ন করে। গত শনিবার আমি জলন্ধর স্টেশনে গ্রেপ্তার হতে হতে বেঁচেছি। এখন আপনাদের উদ্দেশে এই চিঠি লিখছি আম্বালার গ্রাম থেকে। লিখছি, আপনাদের একটা সুখবর দিতে। গতকাল আমাদের গ্রামে ছদ্মবেশে এসেছিলেন কমরেড সুভাষচন্দ্র বসু!’
গ্রামোফোন রেকর্ড থামিয়ে লোকটা পুনরায় চালনা করলেন।
‘...ছদ্মবেশে এসেছিলেন কমরেড সুভাষচন্দ্র বসু! আমাদের ‘গদর’ পার্টির প্রেসিডেন্ট তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করছেন। শীঘ্রই তিনি সুভাষবাবুকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের দিকে গোপনে প্রেরণে সাহায্য করবেন। কলকাতা থেকে আমাদের এজেন্ট ৫৪৮ এবং ১৫৭ এখানে এসে ভারতের বিপ্লবীদের উদ্দেশে সাংকেতিক বার্তা নিয়ে প্রত্যাগমন করেছে। আপনারা যখন আমার খোলাপত্র পাঠ শুনবেন, সুভাষবাবু তখন সিকন্দরদের নাগালের বাইরে চলে যাবেন। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!’
‘সিকন্দর’ এখানে ব্রিটিশ সরকার। ‘ফিদায়েঁ’ অর্থাৎ ইপি এলাকার স্বাধীনচেতা ফকির হাজি মির্জালি খান ওয়াজিরের গুপ্তচর। এই বেতারবার্তা ভেসে এসেছিল ‘গদর’ পার্টির অজ্ঞাত কোনও স্থানের রেডিও সেন্টার থেকে। এখানেই স্পষ্ট, কলকাতা থেকে গোমো স্টেশন হয়ে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র সরাসরি পেশোয়ার যাত্রা করেননি। মধ্যবর্তী স্থান আম্বালায় তিনি রাত্রিবাস করেন। যেখানে ‘গদর’ পার্টি প্রেসিডেন্ট মোহন সিং ভাখ্নার জন্মভিটে, ‘গদর’ পার্টির সবচেয়ে নিরাপদ গোপন আস্তানা! ঘটনাটি জানুয়ারি মাসের। রেডিও ব্রডকাস্ট করা হয় মাসদুয়েক পরে।
২১ জানুয়ারি। সন্ধ্যা নেমেছে। ‘জিয়াউদ্দিন’ নাম অপরিবর্তিত। তবে আর বিমা এজেন্ট নন। সুভাষচন্দ্র এবার মূক-বধির ধর্মপ্রাণ মুসলিম তীর্থযাত্রী। জীবনের দুঃখ-হতাশা নিরসনে চলেছেন আদ্দা শরিফে। মালয়েশিয়ান কাপড়ে নির্মিত সালোয়ার-কামিজ আর চামড়ার জ্যাকেট। সঙ্গে খাকি কুল্লা, লুঙ্গি আর মাথার ফেজ। পায়ে পেশোয়ারি চপ্পল, সঙ্গে কাদুলি কম্বল। এক ইঞ্চি লম্বা দাড়িতে জিয়াউদ্দিন এবং সঙ্গী রহমত খান ওরফে ভগতরাম তলওয়ার।
পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় অগস্ত্য যাত্রা দুর্গম পথে। গাড়িতে চালক আবাদ খান ও গাইড ফরওয়ার্ড ব্লকেরই এক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। জামরোদ রোড, খাজুরি ময়দান। সেখান থেকে হাঁটাপথে পার হলেন সিনওয়ারিদের গ্রাম। পাহাড়-উপত্যকা পাথুরে ভূমি পেরিয়ে পিশকান ময়না গ্রাম। রাত্রির শৈত্যপ্রবাহ পাঁজর ফুঁড়ে যায়। পাঠানের বেশে বেশ মানিয়েছে সুভাষবাবুকে। জন্মদিনেই ভারতের সীমানা ত্যাগ করে এসেছেন। ক্লান্তির কারণে এবার খচ্চরের পিঠে চড়লেন। আফগান উপজাতি অঞ্চলেও ব্রিটিশ গুপ্তচরদের রমরমা। আফগানিস্তানের গরহদি গ্রামের কাছে এক পার্বত্য গ্রামে অ্যাসফল্টে রাত্রিবাস। উপজাতি গ্রামের নববধূর রান্নায় নুন মাখানো পরোটা আর ডিম ভাজা তখন ক্ষুধার্ত মুসাফির সুভাষচন্দ্রের কাছে অমৃততুল্য। গরহদি গ্রাম আফগানিস্তানের প্রায় তেরো মাইল ভিতরে। সেখান থেকে জালালাবাদ চল্লিশ মাইল। সেখানে তখন ব্রিটিশ সরকারেরই মদতপুষ্ট বাচ্চাই সাক্কোর সরকার। তাই স্বস্তির কোনও কারণ নেই।
আর্জানাও গ্রামে দীর্ঘকায় পাঠান ব্রিটিশ এজেন্ট পথ আটকায় সুভাষচন্দ্র ও ভগতরামের। নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। হতদরিদ্র ‘জিয়াউদ্দিন’ শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘চাচার রোগ উপশমে আদ্দা শরিফ যাচ্ছি।’ মিলল নিষ্কৃতি। পদব্রজে মহাযাত্রায় পরের গ্রাম রাসোল। পেশোয়ার থেকে আসা ট্রাকে ‘লিফ্ট’ জুটল। চায়ের বাক্সেই যাত্রা। জালালাবাদ পৌঁছলেন পরদিন রাত্রি আটটায়। এখানেই রাজা আমানুল্লাহ খান ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম করেছিলেন। বাণিজ্যিক কারণে জালালাবাদ শহরে অত্যাধুনিক সব প্রাসাদোপম অট্টালিকা। অর্থাগমের কারণেই বিলাস-বৈভবের এলাহি ব্যবস্থা। তবে কিছুটা বিশ্রাম সেরেই যেতে হবে আদ্দা শরিফ। টাঙ্গাপথে সাড়ে চার মাইল। তবে ‘রহমত খান’ ও ‘জিয়াউদ্দিন’-এর আদ্দা শরিফ আসার কারণ তীর্থ নয়, রাজনৈতিক। আদ্দা শরিফের মসজিদে প্রচলিত প্রথায় প্রার্থনা ও দান সেরে সুভাষচন্দ্র চোখের ইশারায় পথপ্রান্তে এক বৃদ্ধের দিকে নির্দেশ করলেন। মাথায় সবুজ ফেট্টি। ব্রিটিশ চর সেখানেও রয়েছে। তাই কেউই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন।
প্রতিকূল পরিস্থিতি। মরিয়া চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত লালমন গ্রামে হাজি সাহেবের ঠিকানা পাওয়া গেল। রুক্ষ, শুষ্ক, পাথুরে পথে যেতে যেতে আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়ছিলেন সুভাষচন্দ্র। ভগতরাম বিস্মিত, ওই শ্রমমুখী জীবনালেখ্যে কী খুঁজে পেলেন সুভাষবাবু? উত্তর হল, স্বাধীনতা! হোক সে রুক্ষ-শুষ্ক, হোক ফলনশীলতায় কৃপণ—তবু সে দেশে নেই দ্বিশতবর্ষের ব্রিটিশ শৃঙ্খল!
হাজি মহম্মদ আমিন উপজাতিদের নেতা। বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সেই মাটি স্বাধীন রেখেছে তাঁর দল। ধর্মীয় পরিচয় গৌণ হয়ে গিয়েছে জাতীয়তাবোধের সামনে। রুশ, ব্রিটিশ সকল সাম্রাজ্যবাদেরই বিরোধী তিনি। পাখতুন, বালুচদের মধ্যেও তাঁর অনুগামীরা রয়েছে। লালমন গ্রামে চাষবাস ভালোই হয়। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতা রয়েছে। পাথরে কাদা লেপে গড়া বাড়িগুলিতে রয়েছে আত্মার টান। হাজি সাহেবের বাড়ি প্রাসাদ নয়, তবে বেশ বড়। লাগোয়া মসজিদের দরজায় টোকা। ভেজানো পাল্লা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে ‘রহমত’ ভগতরাম বললেন, ‘আমরা এসেছি ‘বজাউর সওয়াল কিল্লা’ থেকে। ওখানেই আমাদের বন্ধু সানওয়ার হুসেন ও সৈয়দ গোলাম মুর্তজা থাকতেন মানিক মুহম্মদ উমরখানের সাথে।’ সুভাষবাবু ঘরের আশপাশটা দেখছিলেন। নামগুলো মন্ত্রের মতো কাজ করল। হাজি সাহেব উপস্থিত ব্যক্তিদের দিকে ইশারা করতেই বন্ধ দরজায় বন্দি হল গোপন আলোচনা! সোভিয়েত ও জার্মানি—ভারতের বিপ্লবে অনুঘটক হয়ে উঠবে দু’টি দেশ। জার্মানি সম্পর্কে সুভাষবাবুর মনে কোনও সংশয় কখনও ছিল না। গত শতাব্দীর তিনের দশকের গোড়ার দিকে যার ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তিনি। হিটলারের সঙ্গে তখনই তাঁর প্রথম দেখা!
কুষাণরাজ কণিষ্কের রাজধানী পুরুষপুর এখন পেশোয়ার। এখানে প্রতিষ্ঠিত ও কপিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু দেশে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যেতেন। আর্যদের আগমন এবং ঋগ্বেদের নানা সূক্ত (বেদমন্ত্র) রচিত এ পার্বত্যভূমিতে। গ্রিক-চৈনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের মতো রুশ জার-সাম্রাজ্যও এই মাটি স্পর্শ করে। ঋগ্বেদে ‘পোক্ত’ জাতি পাখতুনদের পূর্বপুরুষ। পাখতুনরা আরবি-মুঘলদের মতো বহিরাগত নয়, একথা স্পষ্টভাবে ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ গ্রন্থে লিখেছেন সুভাষচন্দ্র। তাই এদেশে পার্বত্য গ্রাম্য সুখী গৃহকোণে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সুখচ্ছায়া আজও অব্যাহত। পাখতুনদের দু’টি ভাষা—উত্তর-পূর্বে ‘পাখতু’, দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘পশতু’। সিন্ধুনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা সভ্যতা থেকেই ‘হিন্দু’ শব্দ এসেছে। ‘সিন্ধু’ শব্দের পাখতু ভাষায় অর্থ নদী। ‘সিন্ধ’ প্রদেশের এই সুমহান ঐতিহ্য বহন করছে এমন দু’টি শাখা—পাখতুন ও বালোচ। পরে আরবদের হাত ধরে এখানে এসেছিল ইসলাম।
ব্রিটিশ সেনা অভিযান কঠোরভাবে প্রতিহত করেছিল পাখতুন-বালোচরা। আমির আমানুল্লার সময় ইংরেজরা মুখে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলেও তাদের বুক চিরে এঁকে দিল ‘ডুরান্ড লাইন’। তার পশ্চিমপারে আফগানিস্তান, পূর্বাংশ তিনভাগ—চিফ কমিশনার শাসিত পাখতুন, এজেন্ট শাসিত পাখতুন, স্বাধীন পাখতুন। বলা যায়, ভারত ভাগের ব্লুপ্রিন্ট সেদিনই রচনা করেছিল ব্রিটিশরা।
পাখতুনরা ওরাকজাই, ইয়ুসুফজাই, মহম্মদজাই, ভিটান্নিস, শিনোয়ারি, আফ্রিদি, মোহমন্দ, ওয়াজিরি, মাসুদ প্রভৃতি উপজাতিতে বিভক্ত। তবে ধর্মীয় পরিচয়ে অধিকাংশই সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলমান। কোরান-হাদিসের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সামাজিক প্রথা ‘পাখতুনওয়ালি’। উপজাতিগুলির মধ্যে গণতন্ত্র রক্ষায় ‘জির্গা’ অথবা বৃদ্ধদের পরিচালিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রয়েছে। তবে উপজাতিগুলির প্রধান গুণ স্বাধীনতা! ১৮৫৮ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশবার আক্রমণ করেও ব্যর্থ হয় ব্রিটিশরা।
সীমান্ত প্রদেশগুলির মানুষের জননায়ক খান আবদুল গফফর খান ‘গান্ধী-এ-সরহদ’ বা সীমান্ত গান্ধী নামে বিখ্যাত। ভারতবর্ষের সঙ্গে দূরত্ব থাকলেও পাখতুনরা নিজেদের ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির বাহকরূপেই বজায় রেখেছিলেন। ১৯২৮ সালের মে মাসে গফফর খান পাখতু ভাষায় ‘পাখতুন’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করলেন। সেখানে স্বাধীনচেতা মানসিকতার পাশাপাশি জাতিসত্তার ভাবও প্রকট ছিল। সেই সময় খিলাফত আন্দোলন চলছে। গফফর খান পাখতুনদের নিয়ে কলকাতায় এলেন কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে। মঞ্চে এক পাঞ্জাবি নেতার সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্নার তুমুল বাক-বিতণ্ডা। জিন্না উদ্ধত হয়ে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানালেন। সব শুনে হতাশ গফফর খান। জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘আপনি আমাদের নেতা; আপনার মর্যাদাবৃদ্ধি আমাদের কাম্য। আপনি যদি একটু সহিষ্ণুতা ও সংযম দেখান, তাহলে কতই না ভালো হয়!’ কিন্তু মহম্মদ আলি জিন্না খুব চটে গেলেন। বিলাস বৈভবে অতিবাহিত তাঁর জীবন। প্রান্তিক মানুষদের প্রতি চরম অবজ্ঞা জিন্নার অন্তরে।
চিৎকার করে উঠলেন, ‘জংলি পাঠানগুলো আজ এসেছে আমাকে, মহম্মদ আলি জিন্নাকে আবদাকায়দা শেখাতে? রাবিশ!’ ক্ষুণ্ণ মনে উঠে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী গফফর খান। নিজের বাক্সটা তুলে অস্ফুট স্বরে একটাই স্বগতোক্তি করলেন, ‘ধন্যবাদ!’ খিলাফত সম্মেলন থেকে সমর্থন তুলে নিল পাঠানরা। পরের বছরই সীমান্ত গান্ধী গড়ে তোলেন পাখতুনদের শক্তিশালী গণ সংগঠন ‘খুদা-ই-খিদমতগার’। অহিংসাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতেও অস্ত্রের প্রয়োজন। গফফর খানের অনুগামীরা এই মন্ত্রেই বিশ্বাস করতেন। আজও সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে সুবিস্তৃত স্বাধীনচেতা উপজাতির মানুষ সেই মন্ত্রেই বিশ্বাস রাখে। রুশ, তালিবান থেকে ব্রিটিশ বা আমেরিকা, যারাই আসুক না কেন, সীমিত শক্তি নিয়ে আজও তারা স্বাধীনতার যুদ্ধে ব্রতী। গফফর খানের ‘খুদা-ই-খিদমতগার’ সংস্থার অধীনে লালকোর্তা বাহিনী অখণ্ড ভারতেরই অংশ হিসেবে নিজেদের মনে করতেন। জাতীয় কংগ্রেস সম্মেলনে বারংবার সেই চিন্তা ব্যক্ত করেছেন তারা।
আজকের বালোচ মুক্তি আন্দোলন কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়। সীমান্ত প্রদেশ সমূহের গণ আন্দোলনের অবিশ্রান্ত ধারা। তাদের পূর্বপুরুষগণ আলেকজান্ডারের দুর্ধর্ষ সেনাদের পরাস্ত করেছিল। অনেকে মনে করেন, ‘বালুচ’ শব্দটি ব্যাবিলনের রাজা ‘বালুস’ থেকে এসেছে। ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণে অবশ্য ‘বালোচ’ পার্সি শব্দ, যার অর্থ ‘কঠিনমনা’।
১৯৪৭ সালে যখন ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এল, সমস্ত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সমূহের অস্তিত্ব তখন বিপন্ন। ১৭ মে মাউন্টব্যাটেন সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে ভারত ভাগ করলেন। গান্ধীজিকে গফফর খান বললেন, ‘মহাত্মাজি, আপনারা এখন থেকে আমাদের পাকিস্তানি বলবেন? কংগ্রেসকেই আমরা আমাদের মঞ্চ মেনেছি, ভারতবর্ষই আমাদের দেশ। আজ আমরা পাকিস্তানি?’ গান্ধীজি জবাবে বলেন, ‘আজ খুদা-ই-খিদমতগারের পরীক্ষা, আবদুল! আপনি প্রস্তাব রাখুন, পাকিস্তান আপনাদের কাছে গ্রহণীয় নয়! আমিও সীমান্ত প্রদেশে যাব!’
গান্ধীজির এমন কথায় সাহায্যের শেষ প্রদীপটাও নিভে গেল। পাখতুনদের ছুঁড়ে ফেলা হল বর্বর নৃসংশ পাকিস্তানি নেকড়ের মুখে। ভগ্ন হৃদয়ে আবদুল গফফর খান বললেন, ‘পাঠানরা একদিনের জন্যও ডোমিনিয়ান স্টেটাস চায়নি। তারা নিজেদের সংবিধান নিজেরাই গঠন করবে। দুই ভারতের যে অংশ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে, তাদের সঙ্গে মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ হবে।’ মুসলিম না কাফের, পাকিস্তান না হিন্দুস্তান— এই সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে পাঠানরা ভোটে অংশ নিল না। ১৯৪৮ সালে ৫ মার্চ পাকিস্তান সংসদে উর্দু ভাষায় দেওয়া বক্তৃতায় গফফর খান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান নামক সাম্প্রদায়িক চিন্তার তিনি শত্রু।’ ১২ আগস্ট যখন চরসদ্দার কাছে বারবা গ্রামে একটি মসজিদের সামনে জুম্মার নামাজ পড়তে সমবেত হয় পাঠান পরিবারের বহু মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা এবং ব্রিটিশ কূটনীতির ফলে সৃষ্ট মুসলিম লিগের পাকিস্তানি পুলিস নিষ্পাপ জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এমন নৃশংসতা জালিয়ানওয়ালা বাগের খলনায়ক জেনারেল ডায়ারকেই একমাত্র স্বস্তি দিতে পারে। পাকিস্তানী কমান্ডার আব্দুল কোয়াইয়ুম ফৌজকে নির্দেশ দিলেন অবিশ্রান্ত ধারায় মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করতে। শান্তির বাণী প্রচারক সীমান্ত গান্ধীর সংগঠন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর অত্যাচারের মাত্রা দেখে জিন্নারও বুক কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তখন রক্তপিপাসু।
বর্তমানে বালুচিস্তান বিশ্ব মানচিত্রে আয়তনে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। উত্তর-পূর্বে খাইবার পাখতুনওয়া, পূর্বে পাঞ্জাব, দক্ষিণ-পূর্বে সিন্ধ প্রদেশ। খনিজ সম্পদের লোভে, অত্যাচারের নেশায় আজ বালুচিস্তানের সার্বভৌমত্ব খণ্ডনে ব্রতী পাকিস্তান। তখন পার্বত্য উপত্যকায় নানা স্থানে লুকিয়ে থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত ‘বালুচিস্তান মুক্তিবাহিনী’। গেরিলা যুদ্ধে পারদর্শী এই মুক্তিসেনার রণকৌশলে বেশ কিছু কেজিবি এজেন্টেরও ভূমিকা ছিল। বর্তমানে বালোচ মানবতাবাদী সংগঠক ডাক্তার মাহরাং বালোচের প্রতিবাদী কার্যকলাপে সন্ত্রস্ত পাকিস্তান। তাঁকে বন্দি করার ফলে বালোচদের প্রতিবাদের ভাষা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বারবার মাহরাং কারারুদ্ধ হয়েছেন পাকিস্তানি সেনা ও জঙ্গিদের হাতে। বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আবহে আবারও গ্রেপ্তার হয়েছেন। জনজাগরণ সেই দেশে বিপ্লবস্পৃহায় পর্যবসিত হয়েছে। বিভিন্ন শহরে স্বাধীনতার ঘোষণা করে পতাকা ওড়ানো হয়েছে। হামলা চলেছে পাকিস্তানি সেনা-পুলিসের উপর। বালোচ মুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে বারংবার ভারতের প্রতি সমর্থন ভেসে আসছে। ধর্ম নয়, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই মানবতার পক্ষে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ঝড় তুলেছে বালুচিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘মা চোখি বালুজানি’! এরশাদ, মুহম্মদ, আমির, তামে প্রমুখ বালোচ যোদ্ধারা গণমাধ্যমে, সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের জাতীয়তাবাদী পরিচয়, জাতীয় সঙ্গীতের শেষ দুই পংক্তির মধ্যে দিয়ে—
‘নিপীড়নের দিন চিরতরে গিয়েছে চলে!
আমরা অসহায়— দরিদ্রের রক্ষক, সন্ত্রাসের দূর্গ ধ্বংসকারী।
আমরা বালোচের সন্তান!
আমরা বালোচের সন্তান!’
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী
tags
রাশিফল
-
আজকের রাশিফল
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
অমৃত কথা
-
জগৎ
- post_by বর্তমান
- জুন 19, 2025
আজকের দিনে
-
ইতিহাসে আজকের দিন
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
এখনকার দর
-
রুপোর দাম
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
সোনার দাম
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
ইউরো
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
ডলার
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
পাউন্ড
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
নিফটি ব্যাঙ্ক
- post_by Admin
- জুন 19, 2025
-
নিফটি ৫০
- post_by Admin
- জুন 19, 2025