টেনইয়ার চ্যালেঞ্জের আড়ালে কি তথ্য পাচার?
দেবজ্যোতি রায়
কোটি কোটি মানুষের দেওয়া ওই ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে কোনও ব্যবসায়িক লাভের জন্য? কিংবা আমাদের উপর নজরদারি চালাতেই কি মুখোশের আড়ালে সংগ্রহ করা হচ্ছে ওই বিপুল পরিমাণ ছবি-তথ্য!
মাস তিনেক ধরে একটা ‘খেলা’ সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব জমে উঠেছে। বিশেষ করে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে। পোশাকি নাম ‘#টেনইয়ার চ্যালেঞ্জ’। অর্থাৎ, ১০ বছর আগে আপনি কেমন ছিলেন। আর এক দশক পড়ে আপনার কতটা পরিবর্তন ঘটেছে। অবশ্যই, আপনার সামাজিক বা আর্থিক পরিবর্তন নয়। চেহারার, আদলের। আর এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুধু ভারত নয়, তামাম বিশ্ব মেতে উঠেছে। প্রথম দিকে ১০ বছর দিয়ে শুরু হলেও কখনও তা নেমে এসেছে পাঁচে, আবার কখনও এগিয়ে গিয়েছে ২০-৩০ বছরে। কে নেই! বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক থেকে তামাম দুনিয়ার সেলিব্রিটি। আর আমজনতা তো আছেই। সকলেই ব্যস্ত নিজের দশ বছর আগের এবং এখনকার ছবি পাশাপাশি ফেসবুক প্রোফাইলে পোস্ট করতে।
সাদা মনে কাদা নেই। আপাতভাবে নিছক মজার একটা সাদামাটা খেলা। দশ বছর আগের আমি আর এখনকার আমিকে ভার্চুয়াল (পরাবাস্তব) জগতের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু সেই নির্দোষ পোস্ট ঘিরেই শুরু হয়ে গিয়েছে সংশয়ের বাতাবরণ। বলা ভালো বিতর্ক। সত্যিই কি এটা নির্দোষ কোনও খেলা নাকি এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র? সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলা ‘চ্যালেঞ্জ’ নাকি আসলে চক্রান্তের মুখোশ! আমাদের সরল মনোভাবেই কি অজান্তে কোটি কোটি মানুষের দেওয়া ওই ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে কোনও ব্যবসায়িক লাভের জন্য? কিংবা আমাদের উপর নজরদারি চালাতেই কি মুখোশের আড়ালে সংগ্রহ করা হচ্ছে ওই বিপুল পরিমাণ ছবি-তথ্য! সতর্ক থাকার জন্য তো একটু সন্দেহপ্রবণ হতেই হয়।
ঠিকঠাকই চলছিল। যতক্ষণ না পর্যন্ত মার্কিন লেখিকা কেট ও’নিল ট্যুইটারে প্রকাশ করেছেন তাঁর সংশয়ের কথা। ট্যুইটারে কেট লেখেন, ‘দশ বছর আগে হলে আমিও হয়তো এই মিমের খেলায় অংশ নিতাম এবং ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে নিজের তখন ও এখনকার ছবি পোস্ট করতাম। কিন্তু দশ বছর পরে আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে, কীভাবে ওই বিপুল তথ্যের খনি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাওয়া মানুষের মুখ চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তিকে (ফেস রেকগনিশন অ্যালগরিদম) এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
গত ১৩ জানুয়ারি কেটের করা ট্যুইট ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার, রি-ট্যুইটের ঢেউ আছড়ে পড়ে সেই মন্তব্যে। বিশ্বের নেটিজেনদের (সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী) একটা বড় অংশের মধ্যেই তৈরি হয় সন্দেহ ও সংশয়। ‘টেক হিউম্যানিস্ট: হাউ ইউ ক্যান মেক টেকনোলজি বেটার ফর বিজনেস অ্যান্ড বেটার ফর হিউম্যান’ বইয়ের লেখিকার যুক্তি, ‘যদি ওদের ফেস রেকগনিশন প্রযুক্তির উন্নতি ঘটাতে হয়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বয়স সম্পর্কিত বিভিন্ন মাপকাঠির তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আর সেজন্য ১০ বছরের চ্যালেঞ্জই উপযুক্ত।’ আর সেই তথ্য সংগ্রহের কাজটাই করছে ফেসবুক, ইনস্টার মতো সোশ্যাল মিডিয়া। এক্ষেত্রে ফেসবুক যে গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন কেট। তাঁর আরও যুক্তি, অনেক গ্রাহকই তাঁদের প্রোফাইলে নিজেদের ছবি লাগান না। তাঁদের থেকে সেই তথ্য আবেগের খেলা ১০ বছরের চ্যালেঞ্জ সংগ্রহ করে নিতে যথেষ্ট। যা তাদের ফেসিয়াল রেকগনিশনকে উন্নত করতে প্রয়োজনীয়। যেই পুরোপুরি কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) নির্ভর ফেসিয়াল রেকগনিশন প্রযুক্তি তৈরি হয়ে যাবে, তখন তারা তাকে আমাদের উপর নজরদারি বা অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতে পারবে। প্রতিদানে অর্জন করতে পারবে বিপুল মুনাফা।
কেটের সংশয় যে একেবারে অবান্তর নয় তা মেনে নিয়েছেন মার্কো ডি’মেলোর মতো সাইবার বিশেষজ্ঞরা। মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অনলাইন নিরাপত্তা প্রদানকারী বিভিন্ন সিকিউরিটি অ্যাপের আন্তর্জাতিক কোম্পানি ‘পি-সেফ’-এর কর্ণধার। তিনি তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘বর্তমানে অনেক ছবির মধ্যে থেকে একটি ছবিকে চিহ্নিত করার অর্থাত্ কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে কোনও মুখকে চিহ্নিতকরণের প্রযুক্তি আছে। কিন্ত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখের আদলে যে পরিবর্তন হয়, তা চিহ্নিত করতে দশ বছর আগের এবং পরের ছবির ওই বিপুল তথ্য ভাণ্ডার প্রয়োজন। যা প্রযুক্তিকে আরও নিঁখুত করতে সাহায্য করবে।’
যদি সরাসরি ঘোষণা করা হতো যে, কোনও এক বিশেষ প্রযুক্তির বিকাশের উন্নতির স্বার্থে এই ভাবে তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহ করা হচ্ছে, তা হলে সংশয়ের কিছু ছিল না। কিন্তু, সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, ইতিমধ্যে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা প্রকাশ্যে আসার পর এটা স্পষ্ট, যে মার্ক জুকেরবার্গের কোম্পানি থেকে মানুষের তথ্য ‘চুরি’ গিয়েছে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে প্রকাশ্যে আসে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারি। জানা যায়, ফেসবুক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আমেরিকা, ভারত, মাল্টা, মেক্সিকোর মতো বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ভোটে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে বিক্রি করেছে। তথ্য ফাঁসের কথা স্বীকার করে নিয়ে মার্কিন সেনেটে জবাবদিহিও করতে হয় জুকেরবার্গকে। ক্ষমা চাইতে হয় গ্রাহকদের কাছে।
এমনিতেই বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারের সময় ‘পারমিশন’-এর নামে গ্রাহকদের মোবাইলের তথ্য সংশ্লিষ্ট অ্যাপ সংস্থার কাছে চলে যাচ্ছে বা তারা অ্যাকসেস করতে পারছে। আধার কার্ডের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে। দাবি করা হয়েছে নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার খর্ব করছে আধার। অভিযোগ উঠেছে চোখের রেটিনা, আঙুলের ছাপ, ফেস রেকগনিশনের তথ্য সংগ্রহ করে কেন্দ্র পরোক্ষে দেশবাসীর উপর নজরদারি চালাচ্ছে। এরপরেও আমজনতা আবেগের বশে কী করে ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমেরিকার হাতে তুলে দিচ্ছে? এমনই প্রশ্ন তুলেছেন এথিক্যাল হ্যাকার তথা ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিংয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সন্দীপ সেনগুপ্ত।
প্রযুক্তির যে গতিতে উন্নতি এবং ইন্টারনেট সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় তা যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে, তাতে আগামী দিনগুলি এআই, ফেস রেকগনিশন এবং ইন্টারনেট অব থিংস-এর যুগ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সারা বিশ্বজুড়ে ফেস রেকগনিশন সফটওয়্যারের চাহিদা বাড়বে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল। ভবিষ্যতে অপরাধী চিহ্নিত করতে ওই প্রযুক্তি সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে। সেই সঙ্গে গোয়েন্দাদের সার্বিক নজরদারির জন্যও সবচেয়ে কার্যকর এই প্রযুক্তি। যদিও, ফেসবুক ১০ বছরের চ্যালেঞ্জের নামে তথ্য সংগ্রহের দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছে। ঘাড় থেকে দায় ঝেড়ে ফেলে কর্ণধার জুকেরবার্গ বলেছেন,‘এই মজার খেলা ফেসবুক কর্তৃপক্ষের তৈরি করা নয়, বরং কোনও ফেসবুক ব্যবহারকারীর তৈরি করা যা ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।’
19th February, 2019