ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
ভারতের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। স্বাধীনতার আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী পর্বের শেষে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হল। সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয়ে গেল দেশ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া। জওহরলালের নেতৃত্বে শুরু হল সেই কাজ। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী আজীবন দেশের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর এলাহাবাদে তাঁর জন্ম। সেই দিনটিকে স্মরণ করে শিশু দিবস পালিত হয়।
আন্তর্জাতিক স্তরে প্রথম শিশু দিবসের ভাবনা আসে ১৯২৫ সালে। সে বছর জেনেভায় পালিত হয় বিশ্ব শিশু কল্যাণ সম্মেলন। তখন বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন দিনে শিশু দিবস পালন করত। ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২০ নভেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস হিসাবে পালন করার কথা ঘোষণা করে। ভারতেও ওই দিনটি শিশু দিবস পালন করা হতো। জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর দিনটি পরিবর্তন করে ভারত সরকার। ১৯৬৪ সালের ২৭ মে নেহরুর জীবনাবসান হয়।
১৯৬৪ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর দিনটি শিশু দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে। শিশুদের প্রতি নেহরুর ছিল অগাধ ভালোবাসা। তারা তাঁকে আদর করে ‘চাচা নেহরু’ বলে ডাকত। শিশুদের কাছে তিনি কোনওদিনই রাষ্ট্রনেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাদের ভালোবাসার চাচা। নেহরু শিশুদের ভালোবাসতেন। তিনি মনে করতেন, শিশুরাই আগামী দিনে দেশকে গড়ে তুলবে। তাদের ভিতরের প্রাণশক্তি এবং দেশের প্রতি ভালোবাসাটুকু জাগিয়ে দিতে পারলেই হবে। তারাই আগামী দিনে দেশের অসংখ্য সমস্যার পাহাড় ডিঙিয়ে এনে দিতে পারবে আরও অনেক সূর্যকরোজ্জ্বল সকাল। প্রতি শিশুর মুখে তিনি দেখতেন সেই আলো জ্বালানোর একজন দক্ষ কারিগরকে।
ঠিক সেই কারণেই তিনি মনে করতেন, প্রতিটি শিশুকে একজন সক্ষম দেশভক্ত নাগরিক হয়ে উঠতে গেলে তার যোগ্য শিক্ষা দরকার। দরকার দেশের ইতিহাস জানার। ঠিক এই ভাবনা থেকেই জওহরলাল তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে নানা বিষয়ে অনেকগুলি চিঠি লেখেন। সেটা ১৯২৮ সাল। তার মধ্যে থেকে ৩০টি চিঠি নিয়ে পরবর্তী কালে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বইয়ের নাম ‘লেটার্স ফ্রম আ ফাদার টু হিজ ডটার’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। দশ বছরের একটি মেয়েকে তার পিতা দূর থেকে চিঠি লিখে জীবনের পথকে চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন। তার মধ্যে দিয়ে নেহরু একইসঙ্গে পিতা ও শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। ইন্দিরা তখন ছিলেন মুসৌরিতে এবং নেহরু ছিলেন এলাহাবাদে। প্রতিটি চিঠির মধ্যে দিয়ে তিনি মেয়ের কাছে তুলে ধরেছেন মানুষের কথা। সেই আদিম কাল থেকে সভ্যতার পথে তার উত্তরণের কথা। মানুষ যে সভ্যতার পথে এগিয়েছে, সেখানে সে কেবল দৈনন্দিন জীবনযাপনের বাধাকেই কাটিয়ে ওঠেনি, সেই সঙ্গে মানুষ আয়ত্ত করেছে তার মূল্যবোধ, তার সংস্কৃতি। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে বাঁচতে হয় একসঙ্গে, তাও মানুষ শিখেছে বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষের ইতিহাসকেও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। মেয়েকে শিখিয়েছেন সেই বিবর্তনের প্রতিটি পদক্ষেপ। শিখিয়েছেন, আমাদের দেশের সংস্কৃতি কত সুন্দর, কত গভীর শ্রদ্ধাবোধের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। নেহরুর আর একটি বই ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ পড়লেও আমরা সেই প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় সভ্যতার অগ্রগতির চিহ্নটিকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পারি। তাঁর আত্মজীবনী ‘অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ বইটিও তাঁর জীবনের লড়াই, আদর্শ ও মূ্ল্যবোধের প্রকাশ। অনুপ্রেরণামূলক এই বইটিতে তিনি বলেছেন, ‘আমি যেমন প্রাচ্যের, তেমনই পাশ্চাত্যের’। এই যৌথ বন্ধন তাঁর মধ্যে এক উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছিল। অস্ট্রেলিয়ার লেখক স্যার ওয়াল্টার ক্রুকার বলেছেন, ‘নেহরুজি যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাও হতেন, তাহলেও তিনি বিখ্যাত হতেন তাঁর এই আত্মজীবনী বইটির জন্য।’
তোমরা অনেকেই হয়তো জানো না, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে অসাধারণ সম্পর্ক ছিল বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের। প্রায়ই একে অপরকে চিঠি লিখতেন। ১৯৫০ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি লেখা একটি চিঠিতে আইনস্টাইন বলেন, ‘আপনার দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইটি আমি পড়েছি। কী অসাধারণ আপনার লেখা। বইটি পড়ে আমি ভারতের যুগ যুগ ধরে প্রবহমান এক পবিত্র সভ্যতাকে চিনতে পেরেছি। আপনার লেখার মধ্যে একটা বুদ্ধিদীপ্ত ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ লক্ষ করেছি। সেটি আমার খুব ভালো লেগেছে।’
ভাবলে অবাক লাগে, কীভাবে মেয়ে ইন্দিরাকে তিনি পুঁথিগত শিক্ষার বাইরেও যে একটা শিক্ষা রয়েছে, তা শিখিয়েছিলেন। সেই শিক্ষা জীবনের দৃষ্টিকে একেবারে উন্মুক্ত করে দেয়। তোমাদের প্রত্যেকের উচিত চাচা নেহরুর বইগুলি পড়া। তাহলে আমাদের দেশ ও মানব সভ্যতা সম্পর্কে তোমরা এমন অনেক কিছু জানতে পারবে, যা তোমাদের সিলেবাসে নেই। চাচা নেহরু মনে করতেন, সিলেবাসের পড়া মানুষকে শিক্ষিত করবে। সিলেবাসের বাইরে যে পড়া, তা মানুষকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো করে গড়ে তুলবে, তার ভিতরে অন্বেষণের আগ্রহ জাগিয়ে তুলবে। নেহরুর এই ভাবনাটিকে পছন্দ করতেন বিশ্বখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী বার্টান্ড রাসেল। নেহরুর সঙ্গে ছিল তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নেহরু যখন জেলবন্দি থাকতেন, তখন রাসেলের বই পড়তেন মন দিয়ে। রাসেল একজন ইংরেজ হলেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল। তিনি নেহরুর বই পড়ে বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় না পাশ্চাত্যে এমন কোনও রাজনৈতিক নেতা আছেন, যিনি নিজের দেশটাকে নেহরুর মতো চেনেন।’
জওহরলাল তাঁর দেশকে চিনেছিলেন, দেশের মানুষকে চিনেছিলেন। তারই অঙ্গ হিসাবে তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। সময় পেলেই তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, গল্প করতেন। বুঝেছিলেন দেশের শিশুদের জন্য সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রয়োজন। যে শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তারা দেশকে ভালোবাসতে শিখবে।
একদিন ছোটদের সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনি বুঝলেন, শিশুদের জন্য স্বাধীন ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়োজন। শুধু শিশুদের শিক্ষা ও বিনোদনের জন্য পৃথক ভাবনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই নেহরু ১৯৫৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন ‘চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি’। সোসাইটি প্রযোজিত প্রথম ছোটদের জন্য ছবিটি নির্মিত হয় তার পরের বছর। ছবির নাম ছিল ‘জলদীপ’।
আজীবন তিনি বিশ্বাস করেছেন শিক্ষা, গণতন্ত্র, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। এই চার মন্ত্রে তিনি বাঁধতে চেয়েছিলেন দেশের শিশুদের হৃদয়কে। সবক্ষেত্রে যে তিনি সফল হয়েছেন, তা নয়। কিন্তু সমস্তরকম অশান্তি, হানাহানি, বিদ্বেষ, হিংসার মধ্যেও অনির্বাণ থাকবে তাঁর জীবন দর্শনের পবিত্র আলোকশিখা। অন্ধকারের মধ্যেও তা তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথে অগ্রবর্তী হতে উৎসাহ দেবে।