মেয়াদি সঞ্চয় বা পৈতৃক সম্পত্তি সূত্রে ধনাগম যোগ দেখা যায়। কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও আর্থিক দিক ... বিশদ
বাদুড়ের কথা বললেই আমাদের প্রথম মাথায় আসে ভাইরাসের কথা। ইবোলা, নিপা থেকে শুরু করে আজকের করোনা। বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর ভাইরাসের বাহক এই বাদুড়। তবে কি বাদুড়ের সাহায্যে জাপানে প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানোর চেষ্টায় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? মোটেই না। এটা ছিল সত্যিকারের বোমা। যার বাহক ছিল বাদুড়।
কীভাবে তৈরি হল এই মারণাস্ত্র? তা জানতে গেলে আমাদের উল্টে দেখতে হবে ইতিহাসের পাতা।
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর। দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার কার্লসবাড ক্যাভার্নে ছুটি কাটাচ্ছেন পেনসিলভানিয়ার দন্ত চিকিৎসক লিটল এস অ্যাডামস। কিন্তু সেখানে গিয়ে এক বিচিত্র জিনিস তাঁর নজরে আসে। দেখলেন কার্লসবাড ক্যাভার্নের গুহায় বসবাস করছে বিভিন্ন প্রজাতির বাদুড়। দেখামাত্র এ নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন অ্যাডামস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে অবশ্য ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর একটি অন্যতম মাইলফলক। সেদিনই পার্ল হারবারে ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিল জাপান। প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন নাগরিক। এই ঘটনার পরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয় আমেরিকা। এর সঙ্গেই শুরু হল অস্ত্র আবিষ্কারের প্রক্রিয়া। এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন আমেরিকার আম জনতা। সামরিক দপ্তরে মাঝেমধ্যেই জমা পড়তে লাগল যুদ্ধ পরিকল্পনার নানান নীল নকশা।
১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে জাতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা কমিটির হাতে এসে পৌঁছল অ্যাডামস নির্মিত বাদুড় বোমার প্রস্তাব। কমিটি তা গ্ৰহণ করল। এরপর এই গোপন অস্ত্রের নীল নকশা পাঠানো হল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দপ্তরে। প্রাণীবিদ ডোনাল্ড গ্ৰিফিনের পরামর্শে চূড়ান্ত অনুমোদন পেল এই বাদুড় বোমা। মার্কিন বায়ুসেনার তত্ত্বাবধানে শুরু হল বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া।
প্রেসিডেন্টের সবুজ সংকেত তো মিলল। কিন্তু এই কাজের জন্য কোন প্রজাতির বাদুড় ব্যবহার করা হবে? শুরু হল বিস্তর গবেষণা। সবকিছু খতিয়ে দেখার পর ঠিক হল, এই বোমা বহন করবে মেক্সিকান ফ্রি-টেলড বাদুড়। প্রথমে ঠিক ছিল এই বোমায় ঠাসা থাকবে সাদা ফসফরাস। তবে শেষমেশ ফসফরাসের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছিল রসায়নবিদ লুই ফিজার আবিষ্কৃত রাসায়নিক ‘নাপাম’।
পরীক্ষা করে দেখা গেল, একটি ১৪ গ্ৰাম ওজনের বাদুড় ১৫ থেকে ১৮ গ্ৰামের পেলোড বহনে সক্ষম। ছোট আকারের কন্টেইনারে ভরা হল নাপাম। এই কন্টেইনারের পোশাকি নাম ছিল ‘এইচ-২ ইউনিট’। বিশেষ সার্জিক্যাল সরঞ্জাম দিয়ে বাদুড়ের বুকের কাছে নরম চামড়ায় লাগানো হল বোমা। বাদুড় বোমা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হল পাঁচ ফুটের ক্যারিয়ার। একটি ক্যারিয়ারে ভরা যাবে হাজারের বেশি বাদুড়। কিন্তু জাপানে নির্বিঘ্নে কীভাবে পাঠানো হবে এই অস্ত্র। মাঝপথেই তা সক্রিয় হয়ে উঠবে না তো? এর জন্য তৈরি করা হল আইস কিউব ট্রে। সেখানেই কৃত্রিম পদ্ধতিতে শীতঘুমে পাঠানো হল বাদুড়দের। ঠিক করা হল, আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হবে ক্যারিয়ার। ৪ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে তা প্যারাশুটের সাহায্যে নামিয়ে দেবে যুদ্ধবিমান। মাটির কাছাকাছি আসতেই খুলে যাবে বাক্সের দু’দিক। বায়ুর সংস্পর্শে আসামাত্র শীতঘুম ভেঙে বেরিয়ে আসবে বোমা বহনকারী বাদুড়ের দল।
আরও দু’বছর ধরে চলল গবেষণা। তবে পরীক্ষার আগেই ঘটে গেল বড়সড় দুর্ঘটনা। ১৯৪৩ সালের ১৫ মে নিউ মেক্সিকোর কার্লসবাডের বায়ুসেনার ঘাঁটির পরীক্ষাগারে আগুন লেগে যায়। পরে জানা যায়, ভুলবশত বোমা বহনকারী বাদুড় বাইরে আসার কারণেই এই বিপত্তি। এরপর আগস্ট মাসে অস্ত্র পরীক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব নিল মার্কিন নৌবাহিনী। ক্যালিফোর্নিয়ার এল সেন্ট্রোয় ম্যারিন কর্পস এয়ার স্টেশনে শুরু হল কাজ। শেষমেশ ইউটায় তৈরি কৃত্রিম জাপানি গ্ৰামে করা হল চূড়ান্ত পরীক্ষা। দেখা গেল, সাধারণ বোমার থেকে অনেক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম এই গুপ্ত অস্ত্র। প্রায় আট মিনিট ধরে জ্বলছে আগুন। নিমেষের মধ্যে জাপানের একাধিক কাঠের শহরকে যা শেষ করে দেবে। বিভিন্ন অঞ্চলে দাবানল দেখে মনোবল ভেঙে যাবে জাপানিদের। জানা যায়, ক্যালিফোর্নিয়ায় নাকি জেনারেলের গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল এই বোমা। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি আরও বেশ কয়েকটি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। তবে পরে জানা গেল, ১৯৪৫ সালের আগে ‘অপারেশন এক্স-রে’-র বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সময়ের পাশাপাশি ততক্ষণে এই অস্ত্রের পিছনে খরচ হয়ে গিয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের যাবতীয় পরীক্ষা বাতিল করলেন ফ্লিট অ্যাডমিরাল আর্নেস্ট জে কিং।
শেষমেশ বাদুড় বোমা প্রয়োগের যাবতীয় পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল ম্যানহাটন প্রজেক্ট। দীর্ঘদিনের গবেষণার পরে পরমাণু বোমা আবিষ্কার করলেন ওপেনহাইমার। এই পারমাণবিক অস্ত্রের সাহায্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি ফৌজকে পরাস্ত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ভাগ্যিস এই বাদুড় বোমা কখনও ব্যবহার করেনি মার্কিন সেনাবাহিনী। করলে হয়তো হিরোশিমা, নাগাসাকির পাশাপাশি গোটা জাপান আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত!