ঠাৎ জেদ বা রাগের বশে কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই শ্রেয়। প্রেম-প্রীতির যোগ বর্তমান। প্রীতির বন্ধন ... বিশদ
এই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকি
খ্রিস্টমাস হল আমাদের কাছে আনন্দের দিন। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাস পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রস্তুতি। ছোট থেকেই এই দিনটির প্রতীক্ষায় থাকি। আমাদের প্রতিটি ক্লাসে চারটে করে সেকশন আছে। প্রত্যেক সেকশন আলাদা করে ক্লাসরুম সাজায়। গোটা স্কুলবাড়িটাও সেজে ওঠে। হোস্টেলের মেয়েরা যিশুখ্রিস্টের জন্মকাহিনী অবলম্বন করে নাটক করে। তারপর বিদ্যালয়ের শিক্ষিকারাও নিজেদের মধ্যে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তবে সেদিনটা স্কুলের পোশাক পরতে হয় না। খুশিমতো আমরা সাজগোজ করি। বছরের শেষদিনগুলি খুব মজা ও আনন্দ করে কাটাই। আর প্রতিবছরই ২৫ ডিসেম্বর আমাকে নতুন বার্তা এনে দেয়। বহু নতুন জিনিস শিখি এই ডিসেম্বরেই।
সোনিকা দে, অষ্টম শ্রেণী
ফ্যান্সি ড্রেস কমপিটিশন
পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। ছোটবেলায় বাবা-মার হাত ধরে কখন যে ভর্তি হয়েছিলাম সেটা ঠিক মনে নেই। কিন্তু যত বড় হচ্ছি এবং উঁচু ক্লাসে উঠছি ততই মায়ার বাঁধনে জড়াচ্ছি। আমাদের স্কুলের প্রতিটি অনুষ্ঠানই খুব সুন্দর। তার মধ্যে খ্রিস্টমাস পার্টি অন্যতম। আমাদের বিশাল বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ সেজে ওঠে নানান রঙের বেলুন, খ্রিস্টমাস ট্রি নানা রঙের ফুল ও পাতায়। প্রতিদিনের মতো প্রভু যিশুকে স্মরণ করে শুরু হয় গান ও প্রার্থনা। ক্লাসরুমটিকে বিশেষ থিমে সাজানো হয়। খুব সুন্দর করে স্টেজ করা হয় বকুলতলায়। নাচ, গান, নাটকের পর থাকে ফ্যান্সি ড্রেস কমপিটিশন। একটা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে পোশাক তৈরি করা হয়। এবছর সেই ফ্যান্সি ড্রেস অনুষ্ঠানে আমি সাজব। ‘আলাউদ্দিন খিলজি’র চরিত্রে। কোয়েনা ঘোষ সেই চরিত্রের ওপর স্পিচ দেবে। সবাই মিলে এখন আমরা ড্রেস তৈরিতে ব্যস্ত। প্রতি বছরের মতো এবছরও পুরস্কার জিততে হবে। তাই সবসময় ভাবছি ও পড়াশোনা করছি আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্রটা নিয়ে।
স্নেহা দাস, নবম শ্রেণী
উপহারের অপেক্ষা
নতুনের সঙ্গে পুরনোর মেলবন্ধন ঘটে এই ডিসেম্বর মাসেই। আমাদের স্কুলের বয়স ১৮৭ বছর। তাই স্কুলে প্রাক্তন ছাত্রীর সংখ্যাও বহু। সেদিন তারাও উপস্থিত হয় স্কুলের অনুষ্ঠানে। এক সুন্দর পরিবেশে শুরু হয় অনুষ্ঠান। গান ও প্রার্থনার পর সবাই ক্লাসে আসি। তারপর একে অপরকে উপহার দেই। সেই উপহারগুলি পেয়ে সবাই যেন খুশিতে ঝলমল করতে থাকে। কোনও টাকার অঙ্কে আমরা সেই উপহারের বিচার করি না। প্রতিবছর এই উপহারের অপেক্ষায় থাকি। পরস্পরের মেলবন্ধনে এক অপূর্ব মাত্রা নেয় ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান।
দীনান্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবম শ্রেণী
কেক খাওয়ার আনন্দ
বাড়িতে আজকাল প্রায়শই কেক খাই। তাছাড়া বাবা-মা জন্মদিনে তো স্পেশাল কেকের আয়োজন করেই থাকে। সেই কেক আমরা পরিবারের সকলের সঙ্গে খাই। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে বছরে একবারই আনন্দ করে খাওয়া হয়। স্কুলে সেদিন প্রার্থনা ও গানের শেষে আমরা সবাই ক্লাসে আসি। প্রত্যেক ক্লাসে স্কুলের তরফ থেকে কেক পাঠানো হয়। সেই কেক খাওয়ার আনন্দই আলাদা। আমাদের দু’হাজারের বেশি ছাত্রী ছাড়াও শিক্ষিকারা প্রাক্তনীরা সবাই কেক খায়। সেই কেক খাওয়ার দৃশ্য রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। একসঙ্গে গোটা স্কুল কেক খাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। এই উৎসবে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
অঙ্কিতা মিত্র, ষষ্ঠ শ্রেণী
ক্লাসরুম সাজানো
যিশুখ্রিস্টের জন্মদিনে পৃথিবীব্যাপী মানুষ আনন্দে মেতে ওঠে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুলও প্রতিবছর শামিল হয় তাঁর জন্মদিনে। পরীক্ষা শেষে শুরু হয় স্কুল প্রাঙ্গণে সাজো সাজো রব। প্রতিটি ক্লাসেই শুরু হয় আলোচনা। অন্যরা যেন সেই বিষয়বস্তু জানতে না পারে। একেক ক্লাসের চারটে করে সেকশন আছে। তাই প্রতি সেকশন আলাদা করে পরিকল্পনা করে ক্লাসরুম সাজানোর। ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’তে থাকে অভিনবত্ব। কিন্তু সব ব্যাপারটা গোপন থাকে। কেউ কাউকে নিজের সেকশনের কথা বলে না। যে যত নতুনত্ব ও অভিনব করতে পারে সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠান শেষে যারা পুরস্কার পায় তাদের আনন্দে আমরাও আনন্দ করি। এই খ্রিস্টমাস পার্টিতে সবাই হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে।
অদৃজা দে, পঞ্চম শ্রেণী
রূপকথার ছোঁয়া
আমাদের স্কুলে সারাবছরই নানারকম বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তার মধ্যে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান হল ক্রিসমাস পার্টি। যে কোনও একটা নির্দিষ্ট দিনকে বেছে নেওয়া হয় এর জন্য। সবাই মিলে আয়োজন করা হয় এই অনুষ্ঠানের। ক্লাস সাজানো ও যেমন খুশি তেমন সাজো-র ওপরেই পুরস্কার বিতরণ করা হয়। নানা ধরনের প্রতিযোগিতা হয়। তাতে কখনও থাকে রূপকথার ছোঁয়া, কখনও বা থাকে পুরাণের চরিত্র ও ইতিহাসের চরিত্ররা। কিছুতেই জানা যায় না আগে থেকে কে কী পারফরমেন্স করবে। এ নিয়ে একটা কৌতূহল থাকে। তবে যখন ওরা এক-একজন নিত্যনতুন সাজে সেজে স্টেজে ওঠে, তখন ছাত্রীদের মধ্যে কলরোল পড়ে যায়। বিভিন্ন সাজ দেখতে দেখতে ছাত্রীরাই কখন যেন বিচারকের আসনে বসে পড়ে।
দেবারতি শাসমল, ষষ্ঠ শ্রেণী
একান্নবর্তী পরিবার
আমাদের স্কুলের পরিবেশটা খুব সুন্দর। বিশাল বড় খেলার মাঠ, বিল্ডিং। মনে হয় যেন একান্নবর্তী পরিবার। তাই পড়াশোনা করা নিয়ে কোনও ভয় ভীতি কাজ করে না। শিক্ষিকাদের কাছে আমরা বহু কিছু শিখি। স্কুলে শুধু পড়াশোনা নয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যেও আমরা স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা পাই। নিজের জীবন, ঘরবাড়ি কীভাবে সাজাব সেটা আমাদের স্কুলই শেখায় নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষাও স্কুলেই পাই। ক্রিসমাসের অনুষ্ঠানে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। এই স্কুলে না পড়লে জানতামই না সবাই একসঙ্গে মিলে কেক খাওয়ার মজা। জানতামই না গিফট এক্সচেঞ্জ করার আনন্দ। সমস্ত অনুষ্ঠানটা এত পরিপাটি করে হয় যে চোখ ফেরানো যায় না। অনুষ্ঠান শেষের আগে সান্তাক্লজের আগমন দারুণ আনন্দ দেয়। এই সান্তাক্লজ সকলের সঙ্গে গান গেয়ে চকলেট বিতরণ করে। তবে কোন শিক্ষিকা এই সান্তাক্লজ সাজেন আমরা জানতে পারি না।
শ্রেয়া পাত্র, অষ্টম শ্রেণী
অভিনব ক্রিসমাস পার্টি
আমি ছোটবেলায় ২৫ ডিসেম্বর সকালে মোজার মধ্যে করে গিফট পেতাম। চকলেট, কেক আরও কত কিছু। সান্তাক্লজ, চার্চ, ক্রিসমাস ট্রি এসব নিয়ে পাড়ি দিতাম রূপকথার জগতে। তা যেন কখন সত্যি হবে আমি ভাবিনি। স্কুলে যিশুর জন্মদিন উপলক্ষে সুন্দর এক ক্রিসমাস পার্টির আয়োজন সত্যিই অভিনব। বন্ধুরা মিলে দারুণ আনন্দ করি। সবাই অনুষ্ঠান সুন্দর করার কাজে হাত লাগাই। গিফট পাই। গিফট দিই। তবে অনুষ্ঠান শেষ হবার আগে সান্তাক্লজ আসেন। সবাইকে চকলেট দেন। সেই চকলেট পেতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। “We wish you a Marry Christmas” সকলে এই গানটি গাইতে গাইতে সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হয়। তখন খুব মন খারাপ হয়ে যায়। মিলন মেলা ভাঙতে থাকে। বেঁচে থাকে একটাই আশা আসছে বছর আবার হবে।
অন্বেষা মজুমদার, পঞ্চম শ্রেণী
ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুল
লীনা জর্জ, টিচার ইনচার্জ
ভারত তখন পরাধীন। আর কলকাতা তখন জল জঙ্গলে ভরা। শিক্ষা তো দুরস্ত। নেই অন্নবস্ত্রের ঠিকমতো সংস্থান। মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। এই অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায় হল শিক্ষা। সেই ১৮৩২ সালে শুরু হল সলতে পাকানোর কাজ। আলিপুরে তৈরি হল বোর্ডিং স্কুল। মাত্র ২৪ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হল পথচলা। নাম লন্ডন মিশনারি সোসাইটি। পরবর্তীকালে স্কুল স্থানান্তরিত হয় ভবানীপুরে। তখন গার্লস ও বয়েজ সেকশন আলাদা করে চলত। পরে বন্ধ হয়ে যায় বয়েজ সেকশন। স্কুলের নাম বদলে রাখা হয় ইউনাইটেড মিশনারি গার্লস হাইস্কুল।
বর্তমানে এখানে পড়াশুনা করে দু’হাজারের বেশি ছাত্রী। দূরদূরান্ত থেকে আসা মেয়েরা হোস্টেলে থাকে। আছে অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন। খ্রিস্টান ভাবধারায় পরিচালিত স্কুলের সর্বত্র রয়েছে নিয়মানুবর্তিতার ছাপ। প্রাক্ প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সমস্ত বিভাগগুলি একই চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থিত। ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য রয়েছে সুন্দর খেলার মাঠ। আছে ক্যান্টিন। ছাত্রীদের পড়াশোনায় মনোযোগী করে তুলতে রয়েছে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা। আর এতেই স্কুলের রেজাল্ট, খেলাধুলো, কুইজ, গান, নাটক ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে সাফল্যের নজির গড়ে ছাত্রীরা। ওদেরই হাত ধরে স্কুলের ঝুলিতে আসে অজস্র পুরস্কার। সাবেকি বিদ্যালয়ের পরিবেশকে সুন্দর রাখতে রয়েছে অভিভাবকদের আন্তরিক সহযোগিতা। সকলের মিলিত সমন্বয়ে গোটা স্কুলটাই একান্নবর্তী পরিবার। ১৮৭ বছর আগের ছোট্ট চারাগাছটি আজ মহীরুহ। সকলের পাখির চোখ এখন দু’শো বছরের দিকে।