ঠাৎ জেদ বা রাগের বশে কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই শ্রেয়। প্রেম-প্রীতির যোগ বর্তমান। প্রীতির বন্ধন ... বিশদ
শিবাজির মতো যোদ্ধা ছিলেন তিনি। বুদ্ধদেবের জ্ঞান, শংকরাচার্যের ত্যাগ, মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের মানবপ্রেম, প্রভু যিশুর হৃদয় আর স্বামী বিবেকানন্দের কর্মযোগ, দেশপ্রেম ও সেবাব্রতের জীবন্ত ভাষ্য তিনি। তুলনা থাক। মানবজীবনে তুলনার প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য, তবু তাঁর প্রকাশ্য জীবন গাথা আজও অতুলনীয়। অনির্বাণ নেতাজির অনন্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে ইম্ফল কোহিমার সবুজবনানীর পার্বত্য প্রান্তরে, কাবুল কান্দাহারের রুক্ষ দুর্গম পথে, ইউরোপ থেকে এশিয়া বিস্তৃত মহাসাগরের অতলে, মুক্তিতীর্থ আন্দামানের নীল সমুদ্রের তরঙ্গে। বাকিটা মহাকালের হাতে। আগামী ইতিহাস মুখরিত হোক বা না হোক মানব সভ্যতার ইতিহাসে বঙ্গজননীর বড় আপন সন্তান সুভাষ যেন সকলের থেকেই আলাদা, অভিমানীও বটে। নিরুদ্দেশের পথিক হবার পূর্বে জননী প্রভাবতীদেবীকে শেষ প্রণাম করতে পারেননি। সিনেমায় চৈতন্য মহাপ্রভুকে দেখে বেদনার্ত সুভাষ জননী বলে উঠেছিলেন, শচীমাতা জেনেছিলেন তাঁর নিমাই কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু আমার সুভাষ কোথায় গেল আমি জানতে পারলাম না।
অসুস্থ জননী শীতের রাতে নাকি দরজা বন্ধ করতে বারণ করেছিলেন। যদি সুভাষ ফিরে আসে বন্ধ দুয়ার দেখে অভিমানী ছেলে আবার ফিরে যেতে পারে। অবশেষে ১৯৪৩-এর ডিসেম্বরের শেষে না ফেরার দেশে চলে যান প্রভাবতীদেবী। সদ্য মাতৃবিয়োগের তীব্র যন্ত্রণা বুকে নিয়েই সেদিন কালো চশমা পরে কুখ্যাত কালাপানির সেলুলার জেলের যন্ত্রণা, আর্তনাদ আর আত্মত্যাগের শহিদ তীর্থ পরিদর্শন করেন। একান্ত ব্যক্তিগত মর্মব্যথার মূল্যায়ন করেনি আজকের ইতিহাস। সুভাষচন্দ্রের প্রিয় বঙ্গজননী, ভারতজননীর কথা তাঁর লেখনী, ভাষ্যে বারংবার এলেও একপেশে ইতিহাসের রুদ্ধ দুয়ারে নেতাজির প্রবেশ বড় সীমায়িত, কোথাও-বা সীমাহীন অজ্ঞতার অন্ধকারে উপেক্ষার কৌশলী প্রহসন।
নেতাজির মধ্যে যে মেধাবী, সাহসী, রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা, খাঁটি দেশপ্রেম ছিল তা মুগ্ধ করেছিল কবিগুরুকে। এই দেশনায়কের পাশে থাকার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান করেছিলেন সেদিন। গান্ধীজিও শেষে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন ‘দেশপ্রেমিকদের রাজপুত্র’, একদা তাঁর ‘বখাটে ছেলে’ সুভাষকে।
একলা চলা পথের পথিক সুভাষচন্দ্র বীরত্ব আর দেশপ্রেমের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যার মূল্যায়ন গত শতাব্দীর মতো এ শতাব্দীতেও সম্ভব কি না অজানা। অর্ধগোলকময় কর্মকাণ্ড বৈজ্ঞানিকভাবে সুসংবদ্ধ করা না হলেও তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান। কলকাতায় জনসমক্ষে স্বীকার করে তাঁরা শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছেন।
আইসিএস-এর চাকরি প্রত্যাখান করে তিনি দেশবন্ধুকে লিখেছিলেন, দেশসেবার জন্য তিনি আত্মনিবেদন করতে চান। দেশবন্ধুর কাগজের সাব এডিটর কিংবা শিক্ষকতার সামান্য বেতন পেলেই তাঁর জীবন চলে যাবে। তিনি সাংসারিক হবেন না এবং তার জন্য বাড়ির আর্থিক সাহায্য নিতে চাননি। সংবাদপত্র সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ তিনি পেয়েছিলেন। এছাড়াও দেশের বন্ধু সুভাষের ভিতর খুঁজে পাওয়া যায় প্রশাসক সুভাষচন্দ্রকে, সফল ও মানব দরদি এক মেয়রকে। প্রথম কারাবাস ঘটেছিল রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধুর সঙ্গেই। নানা রাজনৈতিক সংঘর্ষ লড়াই-এর মাঝে দু’জনে মিলে দক্ষিণ কলকাতা সেবক সমিতি ও দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা সেবাব্রতী সুভাষচন্দ্রের মনন সন্ধানের অন্যতম অনুদ্ঘাটিত পর্ব। রাষ্ট্রীয় উপেক্ষায় নীরবে অতিক্রান্ত হল দেশের অনন্য সুহৃদ ও সুভাষচন্দ্রের অতিপ্রিয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জন্মের সার্ধশতবর্ষ। নেতাজির হাতে গড়া আজাদ হিন্দ সরকারের পঁচাত্তর বর্ষও বাংলায় প্রায় নীরবে শেষ হয়েছে। নেতাজি ফাইলে প্রকাশিত নানা অকথিত গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য নিয়েও তেমন চর্চা হয়নি বৌদ্ধিক মহলে। জাতির ঐতিহ্য, সংগ্রামের শিকড় ক্রমশ আলগা হয়ে পড়ে স্রেফ বিস্মরণের ধারাবাহিকতায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গন থেকে এক বাংলা বেতার ভাষণে নেতাজি জানিয়েছিলেন, চতুর ইংরেজ এগারোবার তাঁকে কারারুদ্ধ করেও কিছু করতে পারেনি এবং তাঁর প্রত্যাবর্তনে কোনও পার্থিবশক্তি বাধা দিতে পারবে না। রুশ, আয়ারল্যান্ড-এর নেতা ডি ভেলেরা সহ বিশ্বের মোট এগারোটি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধান সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকারকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি আজ পর্যন্ত তাঁর ১৮ বার নানারকমের ‘নিশ্চিত মৃত্যু’র গল্প শোনা গেছে। রহস্যের নায়ক নেতাজিকে নিয়ে জনমানসে জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রকাশ্যে পঞ্চাশ অনূর্ধ্ব যে সুভাষচন্দ্রকে পেয়েছি তাঁর অগ্নিময় দেশপ্রেমদীপ্ত জীবন-এর অনুধ্যান রহস্য উপেক্ষার অন্তরালে হারিয়ে যেতে চলেছে। নানা মনগড়া মিথ, অযাচিত বীরত্ব আর ইচ্ছাপূরণের মোড়কে সিনেমা সিরিয়াল আসল নেতাজিকে হারিয়ে দিচ্ছে বারংবার। বিশ্বভারতী কিংবা রামকৃষ্ণ মিশন যে বিশুদ্ধতা কবিগুরু, বীর সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে বহাল রাখতে পেরেছে তা অবশ্যই দৃষ্টান্তস্বরূপ। কিন্তু নেতাজির ক্ষেত্রে অগভীর গবেষণা নেতাজির আদর্শ ও জীবনী চর্চার পরিসরকে সীমাবদ্ধ করে তুলেছে।
কিশোর সুভাষ একদা তাঁর মাকে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন, ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের দেশ, যুগে তিনি দুর্গতদের উদ্ধার করতে অবতার রূপে আবির্ভূত হন। বাস্তবক্ষেত্রে, আধুনিকতম অবতার পুরুষরূপে সুভাষচন্দ্রকে চিহ্নিত করা যায়। ছাত্রসমাজের কাছে তাঁর আহ্বান ছিল, পরিপূর্ণ ও সর্বাঙ্গীণ মুক্তিলাভ। স্বাধীন দেশে, স্বাধীন আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের জাতি জন্মিতে চায়, বর্ধিত হতে চায় এবং মরিতে চায়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘পুরুষ অবরুদ্ধ আপন দেশে, নারী অবরুদ্ধ নিজ নিবাসে’—এ অবস্থা আর কতদিন চলবে? তিনি আহ্বান করেছেন, ‘যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখি—সে রাজ্যে সকলে মুক্ত, ব্যক্তি মুক্ত, সমাজও মুক্ত, সেখানে মানুষ রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে মুক্ত, সামাজিক বন্ধন হইতে মুক্ত এবং অর্থের বন্ধন হইতে মুক্ত। রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি—এই ত্রিতাপ হইতে আমরা মানবজাতিকে-দেশবাসীকে, মুক্ত করিতে চাই।’ তিনি যেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতোই বলেছিলেন, ‘....যাও চীনা ছাত্রদের মত—রুশ তরুণদের মত—চাষীর পর্ণকুটীরে ও মজুরদের আবর্জনাপূর্ণ ভগ্নগৃহে। তাহাদের জাগাও। আর যাও মাতৃজাতির সমীপে। যাঁরা শক্তিরূপিণী অথচ সমাজের চাপে আজ যাঁরা হইয়াছেন—‘অবলা’— তাঁহাদের জাগাও—বল—
‘‘আপনার মান রাখিতে জননী
আপনি কৃপাণ ধর।’’
অনেক রাজনৈতিক অবতার পুরুষ আজও কোনও কোনও দল বা গোষ্ঠীর কাছে পূজ্য। নতুন প্রজন্মের কিছু শিষ্য-শিষ্যা যাঁরা বিদেশের অবতারবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে এদেশের অন্যতম আধুনিক অবতার নেতাজি সম্পর্কে যখন অনীহা ও উদাসীনতা প্রকাশ করে থাকেন তখন সমাজের অস্থিরতা আর দুর্ভোগ ভবিতব্য হয়ে দাঁড়ায়। নেতাজির প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। নেতাজির জীবন ও বাণী সুলভে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেবার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ সেভাবে হয়নি। সর্বভারতীয় জাতীয় ছুটি কিংবা উৎসবের মাধ্যমে সচেতন করার জন্য কোনও বাস্তবমুখী পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। যে সুভাষকে সাধারণ মানুষ আপন করে যে কোনও জাতীয় দিবসে পতাকার তলায় মালা পরিয়ে বেদিতে বসায় তাঁকেই ভুলিয়ে রাখার, ভুলিয়ে দেবার নানা চক্রান্ত হয়েছে দিনের পর দিন। অনুমান করা যায় তিনি তীব্র ঘৃণা ও অভিমানে পরবর্তীতে প্রকট হতে চাননি। তাঁর জন্য শুধুমাত্র জন্মদিন আছে। তাই সাধারণ মানুষ যুগে যুগে এই শব্দবন্ধ দিয়েই তাঁকে প্রণাম জানাবেন— ক্ষমা করো সুভাষ।