পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
‘ছবি তুলবেন না প্লিজ!’
প্রথম সাক্ষাতেই এমন শর্ত দিয়েছিলেন ‘পথের পাঁচালী’-র দুর্গা, উমা দাশগুপ্ত। নাছোড়বান্দা হয়ে একাধিকবার অনুরোধ করায় শেষে নিমরাজি হন। বলেছিলেন, ‘আসলে দর্শকরা পথের পাঁচালীর দুর্গার ছবিই ভালোবাসে, আমার ছবি নয়। আমি তো উমা সেন।’ কথাগুলি অনেকটা সুচিত্রা সেনের মতোই শোনাল। আসলে শেষের কয়েকটি বছর একাকী, নিভৃতে কাটিয়েছেন উমা। কারও সঙ্গে বিশেষ দেখা করেননি।
৯৫, সাদার্ন অ্যাভিনিউ। এই আবাসনে একসময় থাকতেন উমা দাশগুপ্ত (সেন)। কতবার গিয়েছি ওঁর ফ্ল্যাটে। মুখোমুখি বসেছি, কথা বলেছি। প্রতিবারই মনে হয়েছে, এই সেই দুর্গা—যে অপুকে সঙ্গে নিয়ে সাদা কাশবনের মধ্যে দিয়ে ছুটে গিয়েছিল রেলগাড়ি দেখতে! সাদাকালো সেই ছবিটা আজও ভাস্বর আম বাঙালির মনে। ‘পথের পাঁচালী সিনেমার ৫০ বছরে আমার মনে হয়েছিল অপু-দুর্গার আবেদন যুগ-যুগ ধরে অম্লান।’—২০০৫ সালে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন উমা।
বাবা পল্টু দাশগুপ্ত মোহন বাগানে ফুটবল খেলতেন। উপার্জন ছিল সামান্যই। তবু ছবিতে অভিনয় করার জন্য একটি টাকাও পারিশ্রমিক নেননি উমা। বাবার কড়া নিষেধ ছিল। বদলে সত্যজিৎ রায় দিয়েছিলেন একসেট রবীন্দ্র রচনাবলী। সঙ্গে আরও কিছু উপহার, প্রশংসা আর ভালোবাসা। উমার অভিনয়ে হাতেখড়ি নাটকে, স্কুলবেলায়। তা বলে মোহন বাগানের নামী ফুটবলার পল্টু দাশগুপ্তের মেয়ে সেলুলয়েডে অভিনয় করবে! প্রথমে মেনে নিতে পারেননি অভিভাবকরা। তাই অনুমতিও দেননি। পরে মত বদলান বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পৌত্র, সুকুমার রায়ের পুত্রের প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প।
শ্যুটিং পর্বেই সত্যজিৎ রায় উপলব্ধি করেছিলেন, এই মেয়ের অভিনয় প্রতিভা সহজাত। দুর্গার নিষ্পাপ দৃষ্টি, কোমল মুখে সুখ-দুঃখ মিশ্রিত অভিব্যক্তি ছুঁয়ে যায় দর্শকহৃদয়। ‘পথের পাঁচালী’-র যখন শ্যুটিং শুরু হয়, তখন উমা কলকাতার বেলতলা গার্লস হাইস্কুলে ক্লাস এইটের ছাত্রী। ছবিটি মুক্তির সময় অবশ্য তিনি স্কুল ফাইনাল দিয়েছেন। পড়াশোনা শেষে বেছে নেন শিক্ষকতার পেশা, যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রাথমিক বিভাগে। ২০০০ সালে অবসরের পর আমৃত্যু ডুবে ছিলেন সাহিত্যচর্চায়। বিশেষ করে কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প রচনায়।
‘পথের পাঁচালী’ ছবিটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও উমা বিশেষ কোনও সরকারি স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু বিদেশি পত্রপত্রিকা তাঁকে নিয়ে ছিল উচ্ছ্বসিত। এও লেখা হয়েছিল— ‘Seventeen US magazine have listed Uma Das Gupta the 13 year old handsome Durga of the film as one of the teenagers of the year.’ এর কৃতিত্ব যে পুরোটাই সত্যজিৎ রায়ের, সেকথা উমা নিজে স্বীকার করেছেন।
উমার মৃত্যুর খবরে তাই হতবাক করে তোলে সত্যজিৎ-পুত্র সন্দীপ রায়কে। ডুব দিয়েছিলেন স্মৃতিতে, ‘পথের পাঁচালী-র যে দু’জন শিল্পী বেঁচে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আর একজনই রইলেন। এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছেন। ওঁর সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে, ঠিক মনে নেই। শুধু খবর পাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে ওঁর শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। তাছাড়া উনি সকলের থেকে দূরে থাকতেই ভালোবাসতেন।’ কথায় কথায় সত্যজিৎ রায়ের প্রসঙ্গও উঠে আসে সন্দীপের গলায়—‘পথের পাঁচালী শ্যুটিংয়ের সময় আমার বয়স ছিল দু’বছর। পরে বাবা বলেছিল, ওর সঙ্গে কাজ করে খুবই আনন্দ পেয়েছি। আমাকে বিশেষ কিছু বলতেই হয়নি। উমা সবই নিজের থেকেই করেছে। খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। সব ঠিকঠাকভাবে, সাবলীলভাবে করেছে। আমার ভীষণ পছন্দের একজন।’
উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছিলেন অভিনেতা চিরঞ্জিৎ। দু’জনে একই আবাসনে থাকতেন। চিরঞ্জিৎ ফিফ্থ ফ্লোর আর উমা নাইন্থ ফ্লোরে। স্মৃতিচারণে কিছুটা নস্টালজিক চিরঞ্জিৎ, ‘আগে একবার তিনি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেবারে ফিরে এসেছিলেন। এবার আর লড়তে পারলেন না। ওঁর সঙ্গে সঙ্গে একটা যুগ চলে গেল। একই আবাসনে থাকার সুবাদে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। কখনও লিফ্টে, কখনও বা আবাসনের দুর্গাপুজোয়। মুখে একটা মিষ্টি হাসি থাকত সবসময়। একবার দুর্গাপুজোয় আমার সঙ্গে ধুনুচি নাচও নেচেছিলেন। দেবী দুর্গার সামনে দুর্গার নাচ!’ চিরঞ্জিতের স্মৃতির পাতাতেও উমা আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। ‘পথের পাঁচালী’-তে দুর্গাকে তিনি যতবার দেখেছেন, একই আবাসনে থেকেও ততবার দেখা পাননি উমার। জানালেন, দুর্গার কিছু ফটোগ্রাফ আজীবন আগলে রেখেছিলেন। ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকলে তবেই দেখা যেতে সেগুলি। অভিনেতার মুখে শোনা গেল আরও গল্প—‘শুনেছি ‘পথের পাঁচালী’ রিলিজের পর উনি বাবার সঙ্গে একবার বিয়েবাড়ি বা কোথাও একটা গিয়েছিলেন। সেখানে সবাই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন—‘এই দুর্গা, উনি ওঁর বাবা।’ তখন ওঁর বাবা বলে ওঠেন, ‘আসলে হইচে না। আমি কই, সেটা হইচে আমি পল্টু দাশগুপ্ত। ও আমার মেয়ে।’ মানে উল্টোদিক থেকে বলতে হবে। মেয়ের পরিচয়ে বাবা পরিচিত হতে চাইতেন না। বোঝা যায়, কতটা রক্ষণশীল ছিলেন তাঁরা। তাই মেয়েকে আর কোনও ছবিতে অভিনয় করতে দেননি।’
২০২১ সাল ছিল সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ। বিশ্ব সিনেমায় এখনও এক থেকে দশের মধ্যে গণ্য হয় তাঁর প্রথম সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’। কিন্তু ছবি মুক্তির পর মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছিলেন। বিশেষ করে সাংসদ অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত। রাজ্যসভায় বলা তাঁর কথাগুলি ছিল অনেকটা এইরকম—দেশের দারিদ্র বিক্রি করে বিদেশ থেকে পয়সা আনা হচ্ছে। বিদেশে এই ছবির প্রদর্শন এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। দারিদ্রের এমন করুণ রূপ বিদেশিদের না দেখালেও চলে ইত্যাদি। উমার পাল্টা যুক্তি ছিল, ‘এই ছবিতে দারিদ্রই শেষ কথা নয়। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সংগ্রাম করে মানুষের বেঁচে থাকার ছবি ‘পথের পাঁচালী’। মানিকদা ছবি করার সময় প্রকৃতির সঙ্গে মানবজীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন। ছবিতে অপু-দুর্গার খুনশুটি, এ যেন স্নেহ-ভালোবাসায় ভাইবোনের চিরন্তন বন্ধন। ছবিতে আমি আর সুবীর অপু-দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করলেও আসল কাজটা করেছিলেন মানিকদাই। এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মানিকদা ওয়াজ আ মাস্টার অব ইন্ডিয়ান ফিল্মস।’
সহকারী আশিস বর্মনের মাধ্যমে উমার খোঁজ পান সত্যজিৎ রায়। বিজয়া রায় ‘আমাদের কথা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি ওকে সাজাতে সাজাতে বুঝতে পারলাম, এত ভালো দুর্গা আর পাওয়া যাবে না। বড় সুন্দর চোখ, নাক আর ঠোঁট। তাছাড়া চেহারাও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ঠিকমতো সাজিয়ে যখন বসবার ঘরে নিয়ে গেলাম, মানিক হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই তো দুর্গা’!’ ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের প্রথম খসড়ায় কিন্তু দুর্গা ছিল না। ছিল শুধুই অপু। একদিন ভাগলপুরে একটি মেয়েকে দেখতে পেয়ে বিভূতিভূষণের মনে হয়েছিল এই মেয়েকে উপন্যাসে না আনলে চলবে না। ‘পথের পাঁচালী’ আবার নতুন করে লিখলেন তিনি। বিভূতিভূষণের সেই দুর্গা বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসে সিনেমার পর্দায়, উমার হাত ধরে।
সারাজীবনে একটিমাত্র ছবিতেই অভিনয় করেছেন উমা। সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাই। ডি. সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’-এর কিশোর ব্রুনো চরিত্রে এনজোর মতো ‘পথের পাঁচালী’-র সুবীর ও উমা বিখ্যাত হয়ে আছেন কার্যত একটি ছবিতে অভিনয় করেই। কথা প্রসঙ্গে সুবীর বলেছিলেন, ‘আমি সকলের মাঝে অপু হয়েই বেঁচে থাকতে চাই।’ সেভাবে উমাও দুর্গার ইমেজটা ধরে রাখতে চেয়েছেন আজীবন। ক্যামেরায় নিজের ছবি তুলতে দেননি। শেষ বয়সেও সেই জেদ বজায় ছিল।
একবার নানান কথার ফাঁকে উমা বলেছিলেন, ‘আজ পর্যন্ত যতবার ‘পথের পাঁচালী’ দেখেছি, ততবারই বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়েছি। কলকাতায় থাকাকালীন কাগজে পড়েছিলাম সেই নিশ্চিন্দিপুর, সোনাডাঙার মাঠ দেখানো হচ্ছে নিউ ইয়র্কের ফিফথ অ্যাভিনিউতে। ডিসকাউন্টে বিক্রি করা হচ্ছে সিনেমার টিকিট। আসলে কিশোরী মনের মনস্তত্ত্ব পরিস্ফুটনে দুর্গা চিরন্তন। রানুর মতো তারও একদিন বিয়ে হবে। তাই তো সে ছুটে গিয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতো আয়নায় নিজের মুখ দেখেছে। টিপ পড়েছে কপালে, কাজল দিয়েছে চোখে, পুণ্যিপুকুর ব্রত পালন করেছে। কিন্তু কালবৈশাখী তাকে ডাক দিয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার। তাই ব্রতের ঘট ফেলে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়ে গিয়েছে আম কুড়োতে।’
কথা বলতে বলতে উমা বারবার স্মরণ করতেন সত্যজিৎ-বিজয়া রায়কে। প্রথম প্রথম ঘন ঘন যোগাযোগ থাকলেও বিয়ের পর সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে রায়বাড়ির সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কমে এসেছিল। ‘পথের পাঁচালী’ ছবির খুঁটিনাটি ছিল তাঁর মুখস্থ। নিজেই বলতেন, ‘টুনুর পুতির মালা চুরি যাওয়ার দৃশ্যে মানিকদা করুণাদিকে বলে দিয়েছিলেন, আমি ব্যথা পাব একথা না ভেবে তিনি যেন আমার চুল ধরে টেনে-হিঁচড়ে দরজার বাইরে বের করে দেন। ভাবুন তো সেই দৃশ্যটা একবার! প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চুলের নীচে ঘাড়ের শিরাগুলো ফুলে গিয়েছিল। খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। মারের শব্দে অপুর চোখের পাতা আচমকা নড়ে উঠেছিল।’
বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য শ্যুটিংয়ের সময় ক্যামেরায় চোখ রেখে সত্যজিৎ দেখেছিলেন, অপু-দুর্গা ঠকঠক করে কাঁপছে। দুর্গা বিড়বিড় করে বলছে, ‘নেবুর পাতা করমচা, হে বৃষ্টি ধরে যা।’ শটের পর দুধের সঙ্গে ব্র্যান্ডি খাইয়েছিলেন দু’জনকে, শরীর গরম করাতে। সেই সব দিন উজ্জ্বল ছিল উমার মনে, কথায়—‘দিনের পর দিন বৃষ্টির আশায় আমরা প্লাস্টিকের শিটের নীচে বসে গল্পগুজব করতাম। কখনও বা মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। অপুকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টিতে ভেজার সময়ে প্রাক-জ্বরের সিকোয়েন্সে কিছুতেই হাঁচি হচ্ছিল না। শেষে মানিকদার পরামর্শে বংশীবাবু আমার নাকে নস্যি দিয়ে হাঁচিয়ে ছিলেন।’ আর দুর্গার অশ্রুসজল মুখ? কিছুক্ষণ একটু আনমনা হয়ে থেকে উমা জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইন্দির ঠাকুরুনের মৃত্যুর পর তার দাওয়ায় বসে দুর্গার নীরব কান্না—সেটাকে কিছুতেই ফোটাতে পারছিলাম না। সেই খামতি পরিচালক শুধরে দিয়েছিলেন নিজের মুন্সিয়ানায়। দুর্গার অশ্রুসজল মুখ আলো-আঁধারিতে ক্যামেরায় ধরে তৈরি করেছিলেন শোকের আবহ।’
মনোজ মিত্রের মতো উমা দাশগুপ্তকে নিয়েও একাধিকবার মৃত্যুর গুজব রটেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। হঠাৎই একদিন ফেসবুকে ভেসে উঠেছিল ওঁর মৃত্যুর খবর। ফোন করেছিলাম সেই পোস্টদাতা চলচ্চিত্র সাংবাদিককে। বলেছিলেন, ‘জেনুইন খবর। বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া।’ একটুও দেরি না করে মোবাইলে ধরলাম উমাকে। যথারীতি স্নেহমাখা গলায় জিজ্ঞাসা, ‘মৃত্যুর খবর?’ আমার ইতস্তত করা গলা বুঝতে পেরে নিজেই বললেন, ‘দুর্গারা চিরদিনই অবহেলিত। ছবিতেও অপুকে ঘিরে বাবা-মায়ের নানান স্বপ্ন দেখা গেছে। দুর্গা নয়, হরিহর বা সর্বজয়ার কাছে অপুরই আদর ছিল বেশি। জীবনে কিছুই না পাওয়ার বেদনায় দুর্গারা যেন আজও মর্মাহত। পড়াশোনাতে অপুর অধিকার, দুর্গার নয়। রেলগাড়ি দেখাতে অপুরই অধিকার, দুর্গার নয়। দুর্গার অধিকার শুধু রাঙি গাইয়ের বাছুর খোঁজায়, পুণ্যিপুকুরে ব্রত পালনে, অপুষ্টিজনিত রোগে, শেষে অকালমৃত্যুতে।’
মনে পড়ে গেল, কয়েক বছর আগে ‘পথের পাঁচালী’-র অপুর বলা কথাগুলি, ‘পথের পাঁচালীর প্রিমিয়ার শো-তে দিদির মৃত্যুর দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম।’ এখন কি সত্যি সত্যিই অপু কাঁদছেন, স্বজন হারানোর ব্যথায়? কারণ দুর্গার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিজের দিদির মতোই। শ্যুটিংয়ের বাইরেও চলত দিদি-ভাইয়ের খুনশুটি। সেই দুর্গার চলে যাওয়াতে স্বজন হারানোর মতোই দুঃখ পেয়েছেন সুবীরবাবু। দিদিকে হারিয়ে ভালো নেই তিনি। তার মধ্যেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন—‘বাঙালির এক সময়ের নস্টালজিয়া, সিনেমার অপু-দুর্গাকে ক’জন মনে রেখেছে? নতুন প্রজন্ম দুর্গার খোঁজ রাখেনি। কোনও টিভি চ্যানেলে, খবরের শিরোনামে কোথাও তেমনভাবে ঠাঁই পেল না দিদির মৃত্যুসংবাদ।’
‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে বৃষ্টি ভিজে জ্বর হয়ে দুর্গার অকালমৃত্যু হয়। ছবির শেষে সত্যজিৎ দেখিয়েছেন, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে মা-বাবার সঙ্গে গরুর গাড়ি করে কাশীর উদ্দেশে রওনা দিচ্ছে অপু। বিভূতিভূষণের লেখায় আছে, নিশ্চিন্দিপুর থেকে ট্রেনে কাশী যাওয়ার পথে মাঝেরপাড়ায় ডিসট্যান্স সিগন্যালখানা মনে করিয়ে দেবে অযত্ন অবহেলায় মরে যাওয়া পাড়াগেঁয়ে মেয়ে দুর্গার কথা। তাঁর আর্তি, ‘অপু, সেরে উঠলে আমায় একদিন রেলগাড়ী দেখাবি?’ ছবিতে সর্বজয়া চুল বেঁধে দেওয়ার পরপরই দুর্গাকে জিজ্ঞাসা করেছে অপু, ‘একদিন (রেলগাড়ি দেখতে) যাবি?’ রেলগাড়ি দেখা হয়নি তার। তার আগেই নিশ্চিন্দিপুর, সোনাডাঙার মাঠ, সকলকে ছেড়ে চলে গেছে দুর্গা।
সুবীরের ইচ্ছা ছিল দিদিকে শেষবার স্বচক্ষে দেখার। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যা থেকে অন্তিমযাত্রা দেখব বলে বসেছিলেন টিভির সামনে। এখনও আক্ষেপ করেন, ‘আশ্চর্য লাগল, একটা টিভি চ্যানেলও দেখাল না। নানারকম খুন-খারাপির খবরের মাঝখানে কেউ জানাল না একবারও, দুর্গা নেই!’
ছবি সৌজন্য: অনির্বাণ দে ও জয়দীপ দে