বিমা প্রভূতক্ষেত্র থেকে অর্থাগম যোগ। গৃহ সংস্কার বা ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যেতে পারেন। শরীরের ... বিশদ
ব্ল্যাক ডায়মন্ড যখন মানকর স্টেশন ছুঁল, তখন সকাল ঠিক সাড়ে আটটা। স্টেশনের বাইরে অটো অপেক্ষা করছিল। খানিকটা এগিয়ে তিন মাথার মোড়ে মাটির ভাঁড়ে আয়েশ করে চা খেয়ে আবার সামনে এগলাম। তিন চার কিলোমিটার যাওয়ার পর সোনাগড় থেকে বাঁদিকে রাস্তা বাঁক নিল। শাল পিয়াল, মহুয়া, কেন্দু, সোনাঝুরির ঘন সবুজ অরণ্য ভেদ করে রাস্তা চলে গিয়েছে। সকালের হিমলাগা বাতাস আর বনজ গন্ধে ভেসে এগিয়ে চলেছি। অটোর তরুণ ড্রাইভার অজানা অচেনা গাছপালা চিনিয়ে নিয়ে চলেছে। আমাদের গন্তব্য আউষগ্রাম ব্লক ২, লবণধার গ্রাম। আঁকাবাঁকা সর্পিল কালো পিচ ঢালা রাস্তার প্রায় পুরোটাই গহীন অরণ্য। এই বনে যত্রতত্র হনুমানের দেখা মেলে। নানা বিষধর সরিসৃপ থেকে শুরু করে বুনো খরগোশ, সজারুও দেখা যায়। স্থানীয় ভাষায় হেড়েল বা এক ধরনের নেকড়ে বাঘের দেখাও মেলে এখানে। যেতে যেতেই দেখা মিলল হনুমান আর নানা প্রজাতির পাখির।
শীতকালে লবণধার আর শুড়ির বাঁধে দল বেঁধে আসে পরিযায়ী পাখি। দেশি বি-ইটার, মধু টুনটুনি, তিলে ঘুঘু, কোকিল, বালি হাঁস তো থাকেই। তবে সবথেকে বড় আকর্ষণ ময়ূর। ভাগ্যক্রমে আমরা বেশ কয়েকটা ময়ূরের দেখা পেলাম। বিকেল হলেই ময়ূর আর বনমুরগি বেরিয়ে চাষের জমিতে চলে আসে। শুনলাম নাইট-জার আর তিলে পেঁচার মতো নিশাচর পাখিরা নিশ্চিন্তে বাস করে এই নিশ্চিদ্র অরণ্যে। অবশেষে লবণধার গ্রামে পৌঁছলাম। আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা হয়েছে লবনধার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মাটির দোতলা বাড়িটিতে। দোতলা মাটির এই বাড়িটির দেওয়াল নানা রঙের গাছ, ফুল, পাখিতে চিত্রিত। একদম বাহুল্যহীন থাকার ব্যবস্থা। সামনেই গ্রামের অন্নপূর্ণা মন্দির। যার এক এক স্তরে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি আঁকা।
অনেকেই লবণধার গ্রামকে আলপনা গ্রাম বলে জানেন। আসলে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ির প্রাচীর আর দেওয়াল নানা রঙের গাছপালা, পশুপাখি, ফুল আর আলপনায় সাজানো হয়েছে। পুরো গ্রামটি যেন একটি আর্ট গ্যালারি। গ্রামের অন্নপূর্ণা মন্দিরে গ্রাফিতির কাজ দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেই কাজই সম্পূর্ণ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ। এ গ্রামের অর্ধেক মানুষই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। তাই আদিবাসীদের লোকায়ত শিল্পের ছাপ রয়েছে এই চিত্রকলায়।
এবার গ্রাম দেখতে বেরনোর পালা। বাঁশ বাগান, ধানের গোলা, মেঠো পথে গোরুর পাল নিয়ে মাঠে চরানো, সবই পাবেন এই গ্রামে। আমরা আদিবাসীদের কাঁঠালপাড়ায় পৌঁছলাম। পুকুরে হাঁস চরছে, আদিবাসী রমণীরা গার্হস্থ্য কাজে ব্যস্ত। ওধারে বড় মহুয়া গাছের তলায় গোল হয়ে বসে কিছু মহিলা শালপাতা দিয়ে থালা বানাচ্ছেন। গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ঠাকুরতলা। এখানে শিবের গাজন থেকে দুর্গাপূজা সব হয়। প্রতিটি মন্দির সাজানো হয়েছে নিখুঁত ছবি আর আলপনায়।
ঠাকুরতলার এক প্রান্তে টেরাকোটার কাজ করা প্রাচীন চারশিব মন্দির। ১৮২৯ সালে লবণধার গ্রামের বর্ধিষ্ণু রায় পরিবারের গদাধর রায় এই মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্য পূজা এখনও হয়ে যাচ্ছে। চারটি মন্দিরের একটি দেউল আকৃতির ও বাকি তিনটি আটচালা শৈলীর। পানাগড়, গুসকরা, বর্ধমান আর চৌপাহাড়ি অরণ্যের ঘেরাটোপে গ্রামটি যেন নিজেকে লাজুক বধূর মতো লুকিয়ে রেখেছে।
রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম ভোরে উঠব বলে। সকালের নগরকীর্তনে ঘুম ভেঙে দেখি চারপাশ হাল্কা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বেরিয়ে পড়লাম ভোরের অরণ্য দেখতে। রহস্যময়ী ঘোর লাগা কুয়াশা ভেদ করে সবে গাছের ফাঁকে সোনালি রোদ এসে পড়েছে। জঙ্গলের শুঁড়ি পথ ধরে কিছুটা এগতেই দেখি কয়েক জন আদিবাসী বালক গাছের নীচে কিছু খুঁজে চলেছে। আদিবাসী মহিলারা দল বেঁধে চলেছেন জঙ্গলের দিকে শাল পাতা আর কেন্দু পাতা সংগ্রহ করতে। আমরা পায়ে পায়ে শুঁড়ির বাঁধের দিকে এগলাম। সারা জলাধার পদ্মপাতা আর ফুলে ভরা।
একদিনেই গ্রামের মানুষগুলো কেমন যেন আপন হয়ে গিয়েছিলেন। দুপুরে ফেরার সময় সবাই আমাদের এগিয়ে দিলেন। যেন বহুদিন বাদে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি। বলে এলাম ‘আবার আসব’। এমন সবুজগন্ধি কুয়াশামাখা ভোর, ছবির মতো গ্রাম ও সরল মানুষগুলোর ভালোবাসা সহজে যে ভোলা যায় না!
কীভাবে যাবেন: হাওড়া স্টেশন থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস অথবা হুল এক্সপ্রেসে মানকর স্টেশনে নেমে অটো করে লবণধার গ্রামে যাওয়া যায়।