ব্যবসায়িক কাজকর্ম ভালো হবে। ব্যবসার প্রসারযোগও বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় সন্তানের বিদেশ গমনের সুযোগ আসতে পারে। গৃহশান্তি ... বিশদ
বিভূতি এক্সপ্রেস বেনারস জংশনে পৌঁছল ঠিক সকাল দশটায়। প্রতিবারের মতো এবারও বন্ধু নাসির তার রংচটা অটো নিয়ে স্টেশনে হাজির। সরকারি ট্যুরিস্ট লজে থাকব না আগেই জানিয়ে দেওয়ায় নাসিরের অটো এবার ছুটছে শহরের মধ্যে দিয়ে লাক্সা রোডের দিকে। রামকৃষ্ণ মিশনের দৌলতে লাক্সা রোড নামটা সবার কাছেই পরিচিত। বেনারস রামকৃষ্ণ মিশনের অপর প্রান্তেই আমদের হোটেল।
বারাণসীর বিখ্যাত ঘাটগুলি পরিক্রমা করার পরিকল্পনা নিয়েই এবার এসেছি। দুপুরের রোদের তীব্রতা কমতেই তাই এসে দাঁড়ালাম দশাশ্বমেধ ঘাটের বাঁধানো চত্বরে। পড়ন্ত বিকেলের অস্তগামী সূর্যের আলো লুকোচুরি খেলছে গঙ্গার ছোট ছোট ঢেউগুলোর সঙ্গে। দূরে অজস্র নৌকা পর্যটকদের নিয়ে বেড়িয়েছে নৌবিহারে। বাকি পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে গঙ্গা আরতি দেখার জন্য। তারই মধ্যে কেউ কেউ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে পাতার ঠোঙায় জ্বলন্ত প্রদীপ।
দশাশ্বমেধ ঘাট বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে বিশাল বাঁধানো চত্বর, হেলানো বাঁশের মাথায় তালপাতার ছাতা আর সন্ধেবেলার গঙ্গা আরতি। তীর্থযাত্রী বা ভ্রমণার্থীদের প্রধান আকর্ষণ এই ঘাট। পঞ্চতীর্থের অন্যতম এই ঘাটের জল অতি পবিত্র পুণ্যার্থীদের কাছে। পুরাণ অনুযায়ী, একবার ভগবান ব্রহ্মা কাশীর রাজা দিবোদাসের সহায়তায় দশটি অশ্ব বলি দিয়ে এই স্থানে যজ্ঞ করেছিলেন। সেই জন্য ঘাটটির এইরূপ নামকরণ। অন্য মতে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভারসির রাজারা কুষাণদের পরাস্ত করে এখানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। দশাশ্বমেধ ঘাট দিনের এক এক সময় এক একরকম চেহারা নেয়। লোকের মনে সেই ছবিই গেঁথে থাকে চিরকাল। ঘাটের গঙ্গারতির খ্যাতি জগদ্ব্যাপী।
পরদিন কাকভোরে নৌকায় চেপে বসেছি। নৌবিহার করতে করতেই দেখে নেওয়া যাবে অন্য সব ঘাট। আসলে বারাণসীর ইতিহাস আর সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হল, শহর স্পর্শ করে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীর তীরে অজস্র ঘাট। গঙ্গার গতিপথে এত ঘাটের সমাহার বারাণসী ছাড়া আর কোথাও নেই। সংখ্যায় প্রায় একশোর কাছাকাছি ঘাট একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। তবে নাম সব আলাদা। এইসব ঘাটে যুগ যুগ ধরে পড়েছে অগণিত মানুষের পদচিহ্ন। নদীর এক তীরে বিশাল বালির তট। অপর প্রান্তে অর্ধচন্দ্রাকৃতি তীরটি। যেখানে শোভা পাচ্ছে বর্ণাঢ্য মন্দিররাজি, সুদৃশ্য প্রাসাদ বা সুউচ্চ অট্টালিকার সারি।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে পাল্টে যায় এইসব ঘাটের জীবনধারার ছবি। ভোরের আলো ফোটার আগেই অন্ধকারে ঢাকা ঘাটে সাধু-সন্তদের সুমিষ্ট মন্ত্রধ্বনি, পুরোহিতের আনাগোনা, ঘোষণা করে নতুন দিনের আগমনবার্তা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার স্নানার্থীর উপস্থিতিতে কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে ঘাটগুলি। নৌকায় চেপে শহরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাট পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়েন ভ্রমণার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মব্যস্ততা ও কলরবের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। বিকেল থেকে বদলে যেতে থাকে চিত্রটা।
বারাণসীর এই সমস্ত ঘাটের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় শহরের বেশ কয়েকটি ঘাট আছে যেগুলি ৩৫০ বছরেরও পুরনো। প্রায় ৫০টার মতো ঘাটের বয়স ১৫০ বছরের বেশি। ঘাটগুলির নামকরণেও বেশ বৈচিত্র্য আছে। রাজা, মহারাজা, দেব-দেবীর নাম, পৌরাণিক চরিত্রের নাম, শ্মশানের নাম, মঠ বা সন্ন্যাসীর নাম বা ধনী ব্যক্তিদের নামে ঘাটগুলির নামকরণ হয়েছে। নদীর কিনারা বরাবর ঘাটগুলির বিন্যাসের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে গঙ্গার পলিমাটি শুধুমাত্র দক্ষিণপাড়ে জমা হয়, ফলে শহর থাকে পলিমুক্ত।
ঘাট পরিক্রমা শুরু হয় শহরের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে। সেখানে অসি ঘাট। অসি ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই ঘাটটির নামকরণ অসি নদীর নামানুসারে। পঞ্চতীর্থের অন্যতম এই ঘাটের জল অতি পবিত্র। ঘাটের উপর অবস্থিত পঞ্চরত্ন মন্দির ঘাটটির শোভাবর্ধন করেছে।
এরপর চৌষট্টি যোগিনী ঘাট। নিকটবর্তী চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের নামাঙ্কিত এই ঘাটটির সঙ্গে বঙ্গদেশের মহারাজ প্রতাপাদিত্যের নাম জড়িত। ঘাটের উপর তাঁর তৈরি দুর্গামন্দির। দেবী দুর্গাকে ঘিরে চৌষট্টি যোগিনীর মূর্তি। সেগুলো আজ আর নেই। তবু ঘাটের নাম চৌষট্টি যোগিনী রয়ে গিয়েছে। একসময় এই ঘাটটি ছিল উদয়পুরের মহারাজার মালিকানাধীন। আশ্বিন মাসে নবরাত্রির সময় এই মন্দিরে মহাসমারোহে চৌষট্টি যোগিনীর পুজো কিন্তু আজও হয়।
পরপর দেখা যায় নারদ ঘাট, মানসরোবর ঘাট, রাণা ঘাট। দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা ঘাটের নাম। তাই চিনতে অসুবিধা হয় না।
এরপর পৌঁছলাম মুনশি ঘাট। স্থানীয় ধনী ব্যক্তি মুন্সি শ্রীধর প্রথমে এই ঘাটটি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে গঙ্গাতীর সহ ঘাটটি কিনে নেন দ্বারভাঙার মহারাজা। ঘাটের উপর তৈরি করেন রাজকীয় প্রাসাদ। ইদানীং কালে প্রাসাদটি একটুআধটু ভোল পাল্টে বিলাসবহুল হোটেল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই-এর নামাঙ্কিত অহল্যা ঘাট। এই ঘাটটির মালিক ছিলেন নাগপুরের রাজা। পরবর্তীকালে মহারানি অহল্যাবাই এই ঘাটটির মালিক হন। এর পাশেই শীতলা ঘাট।
মানমন্দির ঘাটের নাম শুনলেই একটা রাজস্থানি গল্প যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। অম্বরের রাজা মান সিং এই ঘাটটির উপর একটি সৌধ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে জয়পুরের মহারাজা দ্বিতীয় জয়সিং এই ঘাটের উপর জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক একটি মান মন্দির নির্মাণ করেন। সেই থেকে ঘাটের নাম মানমন্দির ঘাট।
এর পর পৌঁছলাম বেনারসের অতি বিখ্যাত মণিকর্ণিকা ঘাটে। তীর্থঘাট আর শ্মশানঘাট নিয়েই মণিকর্ণিকা। পুরাণ মতে বারাণসীতে বিশ্বেশ্বরের প্রিয়তম এই মণিকর্ণিকা তীর্থ। দশাশ্বমেধ ঘাটের মতো এটিও পঞ্চতীর্থের অন্যতম। পুরাণে কথিত আছে ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের সাহায্যে এখানে একটি কুণ্ড খনন করেন এবং নাম দেন চক্র-পুষ্করিণী। এই পুষ্করিণীর ধারে বিষ্ণু এবং মহাদেবের কথোপকথনের সময় মহাদেবের একটি কানের দুল (মণিকর্ণিকা) পুষ্করিণীতে পড়ে যায়। সেই থেকে এই স্থানের নাম হয় মণিকর্ণিকা। ঘাটের উপর একখণ্ড মার্বেলে রয়েছে বিষ্ণুর চরণ পাদুকা। এই ঘাটটি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মৃতদেহ সৎকারের জন্য সংরক্ষিত। কাশীর বহু ঘাট, মন্দির, শ্মশান ইত্যাদি সরকার অধিগ্রহণ করলেও মনিকর্ণিকা ঘাট এখনও চণ্ডালদের হাতেই আছে।
কেদারনাথ শিবের নামাঙ্কিত কেদার ঘাট বহু প্রাচীন। ঘাটটির উপরেই কেদারনাথ মন্দির। এই ঘাটের বিশেষত্ব হল কাশীর উত্তরবাহিনী গঙ্গার অর্ধচন্দ্রাকৃতি রূপটি এখান থেকে সুন্দর দেখা যায়।
অনুমান করা হয়, পৌরাণিক রাজা হরিশ্চন্দ্রের সঙ্গে এই হরিশ্চন্দ্র ঘাটের যোগাযোগ ছিল। বারাণসীর এটি একটি বিখ্যাত শ্মশানঘাট।
পঞ্চগঙ্গা ঘাট। গঙ্গা, যমুনা, ধূতপাপা, কিরণ ও সরস্বতী— এই পাঁচটি পবিত্র নদীর নামাঙ্কিত এই ঘাটের জল অতি পবিত্র বলে মানা হয়। ঘাটের উপর মোগল স্থাপত্যের অপূর্ব কারুকাজ সংবলিত আলমগির মসজিদ। পাশেই বিন্দুমাধব মন্দির। মসজিদের পাশের গলির মধ্যে মহাযোগী ত্রৈলঙ্গস্বামীর মন্দির ও প্রস্তরমূর্তি।
আদি কেশব ঘাট বা বরুণা সঙ্গম ঘাটটি বরুণা ও গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এই ঘাটটিও পঞ্চতীর্থের অন্যতম বলে এখানে প্রচুর তীর্থযাত্রীর সমাগম হয়। ঘাটের উপর আদি কেশব মন্দির।
সেকালের পণ্ডিতগণ কাশীধামকে একটি মানবদেহ কল্পনা করে বলেছিলেন, ‘অসি সঙ্গম দেহের মস্তক, দশাশ্বমেধ তার বক্ষদেশ, মণিকর্ণিকা নাভি, পঞ্চগঙ্গা ঊরুদেশ আর আদি-কেশব তাঁর চরণদ্বয়’।