পারিবারিক ক্ষেত্রে কলহের আশঙ্কা। ঠান্ডা মাথায় চলুন। বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, সাহিত্যিকদের শুভ সময়। ... বিশদ
গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে একদিন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ডেলফির উদ্দেশে। পাহাড়ের গা বেয়ে ড্রাইভ করে উঠতে উঠতে জল আর পাহাড় ছাড়াও চোখে পড়ল মাইলের পর মাইল জুড়ে কালামাতা অলিভের চাষ। দুপুরের রোদ পড়ে করিন্থ উপসাগরের নীল জল চিকচিক করছে। জলের ধার ধরে মাউন্ট পারনাসাস আর তার ঢাল জুড়ে ডেলফি; ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ও বিশ্বের সবচেয়ে প্রিয় পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ (রুইনস)।
টিকিট অফিস থেকে নেওয়া ম্যাপ অনুযায়ী তোলোস ও অ্যাথেনার মন্দির একদম ওপরে, প্রায় পাহাড়ের চূড়ায়। সেই মন্দির দেখার আশায় পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ের গা কেটে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রাস্তা চলেছে; তাকে বলা হয় ‘সেক্রেড ওয়ে’, অর্থাৎ পবিত্র পথ। একদম শুরুতে রাস্তার এক ধারে বড় বড় থাম আর একদিকে জল। সেখান থেকে নীচে গাড়ি আর বাসগুলো বেশ ছোট লাগছিল দেখতে।
সেক্রেড ওয়েতে হাঁটতে হাঁটতে প্রথম এসে পৌঁছলাম অ্যাপোলোর মন্দিরের সামনে। অ্যাপোলো ছিলেন জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতা। তাঁর কথামতো ধর্মযাজিকা পিথিয়া এই মন্দির থেকেই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী ঘোষণা করতেন। মন্দিরের ভিত ও বড় বড় থাম ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সেক্রেড ওয়ের দুই দিকেই পড়ে আছে কিছু কোষাগারের ধ্বংসাবশেষ। সবচেয়ে সুন্দর ট্রেজারি অব এথেনিয়ান্স। এথেন্সের লোকজনের বানানো মার্বেলের এই মন্দিরটি অ্যাপোলো দেবতার উদ্দেশে বানানো ঠিকই কিন্তু ম্যাপ দেখে বুঝলাম যে ওটা আসল মন্দিরের প্রতিলিপি।
একটা ব্যাপার আমার একটু অদ্ভুত লাগছিল। কয়েকটা জায়গা ম্যাপে দেখানো আছে ঠিকই কিন্তু সেগুলোর কোনও চিহ্নও কোথাও নেই। যেমন ট্রোজান হর্স— কয়েকটা বিশাল পাথরের চাঁই ছাড়া তার আর কিছুই নেই। একটু রাগই হল, পরে ভাবলাম সত্যিকারের ট্রোজান হর্স দেখতে পাব, এমন আশা করাটাও একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল।
পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে বুঝতে পারছিলাম যে চড়াই রাস্তায় ওঠা যতটা সহজ ভেবেছিলাম তা একেবারেই নয়। একটা জলের বোতল সঙ্গে ছিল, তার ভরসাতেই উপরে ওঠা চলতে থাকল। বেশ অনেকটা উপরে ওঠার পর আমরা পৌঁছলাম অ্যাম্ফিথিয়েটার। কী অসাধারণ সুন্দর। মাঝখানে স্টেজ আর চারিদিকে খোদাই করা পাথরের বেঞ্চ যেখানে প্রায় ৫০০০ লোক বসে কনসার্ট শুনত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ওখানে বসে কনসার্ট শোনার দৃশ্য কল্পনা করেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আর এক প্রস্ত পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে পৌঁছলাম একদম শিখরে আর সেখানেই শেষ স্টপ, স্টেডিয়াম। বসার জন্য পাথরের বেঞ্চ তো আছেই, তাছাড়াও চ্যারিয়ট রেসিং ট্র্যাক পর্যন্ত বানানো। কত প্রাচীন যুগের পাথরের বাঁধুনি আর কাজ দেখে অবাক হতে হয় বইকি। এছাড়াও ছিল পাহাড়ের উপর থেকে পুরো ডেলফির দারুণ ভিউ।
এই অবধি পৌঁছে আমরা একটু বিপদে পড়লাম। ম্যাপে দেখাচ্ছিল আশপাশেই কোথাও অ্যাথিনার মন্দির কিন্তু চারদিকে কোথাও কিছু নেই। একটু দূরেই এক এশিয়ান দম্পতি ঘুরছিলেন। তাঁদের প্রথমে জিজ্ঞাসা করলাম তাঁরা ইংরেজি বোঝেন কি না। তাতে উত্তর এল, ‘little bit.’ সেই লিটল বিটের ভরসায় জানতে চাইলাম অ্যাথিনার মন্দিরটা ঠিক কোথায়? তাঁরা যা বললেন তাই শুনে আমাদের তো মাথায় হাত। ওই মন্দির নাকি একদম নীচে, পাহাড়ের শুরুতেই ছিল। কাজেই পুরো পথটা নীচে নেমে গিয়ে দেখতে হবে। অগত্যা, খানিকক্ষণ দম নিয়ে আবার পাহাড় বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামতে নামতে একদম শেষে সেই মন্দির প্রাঙ্গণে গিয়ে পৌঁছলাম। পৌঁছে যা দেখলাম, মন ভরে গেল। না দেখলে অনেকটাই না দেখা থেকে যেত।
ডেলফির সবচেয়ে সুন্দর অবশেষ এই মন্দির ও তার চারপাশের নানা রকমের ‘তোলোস’ বা ভবনের ভগ্নাংশ। ডোরিক বা কোরিন্থিয়ান কলাম ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তবুও পুরো ব্যাপারটাই অসাধারণ সুন্দর। পাহাড় প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই মিউজিয়াম। সেখানে ডেলফি থেকে সংগ্রহ করা মূর্তি, ভাস্কর্য, চিত্র সব কালানুক্রমে সাজানো, সেই সাজানো মিউজিয়ামকে অপূর্ব বললেও কম বলা হবে। ডেলফির এই রুইনস দেখে অসাধারণ তৃপ্তি নিয়ে ফেরার পথে পা বাড়ালাম।