সামাজিক কর্মে সম্মান লাভ। স্ত্রী’র শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ হতে পারে। দেরীতে অর্থপ্রাপ্তি। ... বিশদ
সাহানার কথা
সমীক্ষা আর গবেষণা বাদ দিয়ে এবার কয়েকজন একাকী মহিলার সঙ্গে কথা বলা যাক। শুনুন তাঁদের মনের কথা। দক্ষিণী কন্যা সাহানা আয়ারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই বিষয়ে। বললেন ‘একা বেড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথম যে অনুভূতিটা হয় সেটা একটা অ্যাড্রিনালিন রাশ। অসম্ভব এক উত্তেজনা। বুক ধুকপুক ভাব। সঙ্গে সামান্য একটা ভয়ও যে কাজ করে না, তা নয়। কিন্তু সচেতনভাবে সেই ভয়টাকে জয় করতে পারলে একা বেড়ানোর মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই।’ সাহানার নিজস্ব ব্যবসা। হাতের কাজের নানারকম জিনিস বিক্রি করেন তিনি। প্রথমবার কাজের জিনিস কিনতে, সে বিষয়ে জানতে সুদূর দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তরপূর্বে সিকিম এসেছিলেন। জায়গাটা এবং সেখানকার লোকজনকে এতই ভালো লেগে গিয়েছিল যে সাতদিনের কাজের সফর বেড়ে পনেরো দিনে গিয়ে পৌঁছয়। তাও বিভিন্ন জায়গা অদেখাই থেকে যায়। তখনই পরিকল্পনা করেন আবারও সিকিম যাবেন। পরের বছরই আবার বেড়িয়ে পড়েন বাক্স গুছিয়ে। গন্তব্য নর্থ সিকিমের প্রত্যন্ত অঞ্চল। ‘তবে একা বেড়াতে গেলে আগে থাকতে সব বন্দোবস্ত পাকা করতে হয়। জায়গাটা সম্বন্ধে গবেষণা করতে হয়, কোথায় থাকব সেটা ঠিক করতে হয়, সাইটসিইং ট্রিপ এবং এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে হয়— এগুলো একটু বুঝে শুনে করতে পারলে একা বেড়ানোর মজাই আলাদা’, বললেন সাহানা। তাঁর মতে একা বেড়ানোর মধ্যে একটা স্বেচ্ছাচার রয়েছে। যেমন একবার মুম্বই গিয়েছিলেন সাহানা একা। সেখানে গিয়ে ইন্ডিয়া গেট দেখে এতই মুগ্ধ হন যে সেখানেই দু’দিন কাটিয়ে দেন। ভিডিও করেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের ছবি তোলেন, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ইন্ডিয়া গেটের ছবি তোলেন। এইসব করতে গিয়ে কয়েকটি জায়গা বাদও পড়ে যায়। তবু নিছক ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেওয়ার যে আনন্দ সেটা কিন্তু একেবারে একশোভাগ উপভোগ করেছিলেন সাহানা। ‘পরিবার বা বন্ধু নিয়ে বেড়াতে গেলে এই সুযোগটা হতো না,’ বললেন তিনি। এই ছোটখাট ভালোলাগাগুলোই তাঁর বেড়ানোর আনন্দ। আর সেই আনন্দ সম্পূর্ণ উপভোগ করতেই সাহানা একা বেড়াতে ভালোবাসেন।
মীরার কথা
গুজরাতের মেয়ে মীরা ডেভিড কর্মসূত্রে বহুদিন বিদেশে থাকেন। বিবাহসূত্রে তিনি পুরোদস্তুর বিদেশিনি। তবে একা বেড়ানো যখন শুরু করেন তখনও তিনি বিবাহিত ছিলেন না। আর এই একা বেড়ানোর ভূতটাও তাঁর মাথায় ঢুকেছিল অন্য একজনের কথায়। বিজ্ঞানের গবেষক মীরা সেবার কাজেই গিয়েছিলেন আমেরিকার নেভাডার এক গ্রামে। সেখানে এক পর্যটকের সঙ্গে পরিচয় হলে মীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেন তিনি একা বেড়াতে এসেছেন কেন? পর্যটক ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, ‘বেড়ানোর জন্য একাই ভালো। আর ছুটি কাটানোর জন্য পরিবারের সঙ্গ দরকার।’ তারপর থেকেই তিনি একা বেড়াতে ভালোবাসেন। এবং বিয়ের পরেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। তাঁর স্বামী মীরার এই সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণ সমর্থন করেন বলেই বেড়ানোর স্বাধীনতা বজায় রয়েছে মীরার। তাঁর কথায়, ‘যখন দেশ ছেড়েছিলাম তখনও ভারতের মেয়েরা এতটা স্বনির্ভর হয়ে ওঠেনি। এখনকার ভারত আর তখনকার ভারতের মধ্যে বিস্তর তফাত চোখে পড়ে। পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হওয়ায় আমাদের দেশের মহিলাদের অগ্রগতি যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।’ একা একা বেড়ানোর জন্য কোনও মানসিক প্রস্তুতি নেন কি না, প্রশ্ন শুনে একটু অবাকই হলেন মীরা। তারপর খানিক ভেবে বললেন, ‘আলাদা করে কোনও প্রস্তুতি লাগে না। তবে বয়স বাড়ছে তো তাই শরীরের দিকে সবসময় নজর রাখতে হয়। সামান্যতম শরীর খারাপ হলেও একা বেড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিই। একা বেড়ানোর যে আনন্দ সেটাই যদি শরীর খারাপের কারণে মাটি হয়ে যায় তাহলে আর বেড়িয়ে মজা কোথায়? তাই খেয়াল বা প্রস্তুতি যা নিই সবই শারীরিক ফিটনেস সংক্রান্ত।’
অলকার কথা
‘জীবনটাই আমাদের গবেষণা। আর এই পৃথিবী হল গবেষণাগার। আর জীবন নামক এই গবেষণার সঠিক ফলাফল পেতে হলে একা বেড়ানো ছাড়া গতি নেই,’ বললেন অলকা মজুমদার। তিনি আরও বলেন, ‘বাঙালি মেয়েরা একটু ঘরকুনো। একা বেড়িয়ে পড়ার স্বাধীনতা উপভোগ করতে দ্বিধা বোধ করে। তবু এই ট্রেন্ড ভাঙছে। যেমন আমি একদিন ঠিক করলাম ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ব। একদম ঘরের কাছে দিঘা গিয়েছিলাম সেবার। দারুণ অনুভূতি। এসেই লিখে ফেললাম আমার অভিজ্ঞতার কথা। আর পাঁচজন মহিলাকে জানানোর জন্য শুরু করলাম একটা ট্রাভেল ব্লগ। এখন তো রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই হয়। অর্থাৎ বেড়ানো আর সেই
অভিজ্ঞতা ব্লগে লেখা। অনেকেই আমার ব্লগ পড়েন, কমেন্ট করেন। ভালো লাগে।’ অলকা জানালেন, আমাদের দেশে একা মহিলার বেড়ানোর জন্য সব জায়গা নিরাপদ নয়। তাই প্রচুর পড়াশোনা করে তবে একটা জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যেসব জায়গা মেয়েদের জন্য বিশেষভাবে নিরাপদ তার মধ্যে পড়ে সিকিম আর লাদাখ। এই দুই জায়গার কথা বারবার বললেন অলকা। তাঁর কথায়, ‘সিকিম ও লাদাখে এমন কিছু হোমস্টে রয়েছে যা শুধুই একা মহিলা পর্যটকদের থাকার বন্দোবস্ত করে। তাছাড়া এখানকার মানুষজনও খুব মিষ্টি স্বভাবের। তবে একা বেড়াতে গেলে কিছু জিনিস খেয়াল রাখা জরুরি। এক, শরীর যেন খারাপ না হয়। দুই, কারও ব্যবহার সন্দেহজনক মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। তিন, নিজের চালচলন ও ব্যবহারের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। এই টিপসগুলো মাথায় রাখলে একা বেড়ানোয় কোনও সমস্যাই দেখা দেয় না।’
অঙ্কিতার কথা
কলকাতার মেয়ে অঙ্কিতা সিংহ একা বেড়াতে যান ঠিকই, কিন্তু তাঁর গতিবিধির সম্পূর্ণ খবর পরিবারের কাছে থাকে। বললেন, ‘বিপদে পড়লে যাতে বাড়ির লোক উদ্ধার করতে পারে সেটা সব সময় মাথায় রাখি। আমি মনে করি সাবধানের মার নেই। তাছাড়া একা মহিলা দেখলেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনে হয় একটু সুযোগ নিই। আর সেই কারণেই মেয়েদের অতিরিক্ত সাবধান থাকা দরকার।’ তাছাড়াও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে জায়গা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করেন অঙ্কিতা। সেখানকার লোকজন, খাবারদাবার, ট্যুরিস্ট স্পট ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ নেন। থাকার জায়গা বাছেন প্রচুর ভাবনাচিন্তা করে। এবং তারপর নিজের ট্যুর প্ল্যান ও প্রতিদিনের আপডেট পরিবারের কাছে দিতে দিতে এক জায়গা থেকে অন্যত্র ঘোরেন। প্রথম যখন একা বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন তখন বাড়ির সবাই আপত্তি করেছিল। নেহাত বাবা তাঁর সমর্থনে ছিলেন বলেই অঙ্কিতার একা বেড়ানোর স্বপ্ন সফল হয়। অঙ্কিতা বললেন, বিদেশি ছবি থেকে একা বেড়ানোর প্রতি আগ্রহ জন্মায়। মনে হয়েছিল একা বেড়াতে গেলে নিজেকে আরও ভালো করে চিনতে পারবেন। নিজের ভেতরে ‘আমি’-কে বার করার জন্যই তিনি একা বেড়াতে শুরু করেন। আর এখন তো এটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে।
শেষ কথা
মহিলাদের একা বেড়ানোর নেশা এতটাই ঘোর বাস্তব যে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থাও এখন মহিলাদের জন্য আলাদা ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করেছে। ভারতের হোমস্টে থেকে হোটেল সর্বত্রই এখন সোলো উইমেন ট্র্যাভেলারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা থাকে। নজর থাকে নিরাপত্তার দিকটিও। পর্যটন সংস্থাগুলোর সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে মহিলারা একা বেড়াতে গেলে সাধারণত সিঙ্গল রুম ও হোটেল বা হোম স্টে-তে থাকতে পছন্দ করেন। আর একজন একলা মহিলা পর্যটকের সঙ্গে ঘর শেয়ার করতে বা ডর্মিটারিতে থাকতে তাঁরা ভালোবাসেন না। আবার এই মহিলারাই যখন বিদেশে বেড়াতে যান তখন তাঁরা ইউথ হোস্টেলে বাঙ্ক বেডে শেয়ার বেসিসে থেকে যান। এর কারণটা সঠিক জানা না থাকলেও পর্যটন সংস্থাগুলোর অনুমান এর জন্য খরচ একটা বড় কারণ। যাইহোক মহিলাদের এই একক ভ্রমণ কিন্তু নারী উন্নয়নের পথে একটা বিশাল পদক্ষেপ বলেই সমাজতত্ত্ববিদের মত। মালিনী বললেন, ‘মেয়েরা যে অদম্য তা তারা বহুবার বিভিন্নভাবে প্রমাণ করেছে। একক ভ্রমণ তারই অন্যতম।’