কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদন্নোতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
এ ছুটি উপভোগ করার নয়
যখন আমরা কাজের মধ্যে থাকি তখন আমরা ছুটির গুরুত্ব বুঝতে পারি। খুব কাজের চাপ থেকে দুদিনের একটা ব্রেক আমাদের মনকে চাঙ্গা করে তোলে। কাছের মানুষদের সঙ্গে কয়েকদিন মজা করে কাটানোই হোক বা কোনও বিশেষ দরকারেই হোক ছুটির একটা প্রয়োজন আছে জীবনে। প্রথম যখন লকডাউন ঘোষণা হল তখন মানুষ এটাকে ছুটি হিসেবেই নিয়েছিলেন। অনেকে পড়ে থাকা কাজগুলো করবেন ভেবেছিলেন। যত দিন যাচ্ছে তত মানুষ উপলব্ধি করছেন এটা কতটা বিরক্তিকর, কতটা অস্বাভাবিক। তাই অবসাদ আসছে ডিপ্রেশন বাড়ছে। ছুটি মানে আমাদের কাছে মুক্তির আনন্দ। এ ছুটির যে পায়ে বেড়ি বুকে ভয়। কাজের পরিবেশও মনকে সতেজ রাখে। এই যে আমরা রোজ সকালে ট্রেনে বাসে করে অফিস যাই তাতে যত ধকলই হোক না কেন সেটাও আমাদের মনের রসদ জোগায়। অফিসে নিজের ডিপার্টমেন্ট নিজের টেবল নিজের কাজ সব মিলিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি হয়। যাঁরা কাজকে এনজয় করেন তাঁরা দিনের শেষে একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তি পান। ওয়ার্ক ফ্রম হোমে এই মানসিক তৃপ্তি আসে না। কাজের পরিবেশের সঙ্গে কলিগদেরও খুব বড়ো ভূমিকা আছে জীবনে। দিনের অনেকটা সময় তাদের সঙ্গে কাটে, সুখ দুঃখের কথা হয়, হাসি ঠাট্টা হয় —এটা সম্পূর্ণ নিজের জগৎ। পরিবার জীবনের সমান্তরালে চলতে থাকে। লকডাউনে এই জগৎ থেকেও ছিটকে যেতে হয়েছে মানুষকে। এটাও মন খারাপের একটা দিক।
যাঁরা বাড়িতে থাকেন তাঁরা নিজস্ব সময় হারাচ্ছেন
এটা বাড়ির গৃহিণীদের ক্ষেত্রে বেশি হচ্ছে। সকালে স্বামী কাজে বেরিয়ে যান। ছেলেমেয়েরাও স্কুল কলেজে চলে যায়। সারাটা দিন তাঁরা নিজের মতো করে সময় কাটান। কেউ হয়তো বিশেষ কোনও টিভি সিরিয়াল দেখেন, কেউ হয়তো বাপের বাড়িতে ফোন করেন, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে শপিংয়ে বেরোন, কেউ ফেসবুকে মন দেন। লকডাউনে সবাই বাড়িতে। হয়তো তিনি দুপুরের সিরিয়ালটা দেখতে বসলেন, স্বামী ঘরে ঢুকে মন্তব্য করলেন কী যে ছাইপাঁশ দেখো এসব। ব্যস মেজাজটা বিগড়ে গেল। মুখে একটা ফেস প্যাক লাগাতে যাবেন ছেলে বলল, মা এক কাপ চা দেবে? বিরক্তির এক শেষ। আসলে গৃহিণীরা ঘরে থাকলেও নিজের মতো করে বাঁচেন। এখন সেই একান্ত নিজস্ব জায়গাটা, নিজের সময়টা দখল হয়ে যাওয়ায় তাঁরাও অবসাদে ভুগছেন।
টিনএজাররাও খিটখিটে হয়ে গিয়েছে
কৈশোরে নানারকম অজানা বিষয়ে আকর্ষণ জন্মায়। তখন শুধু বাড়ির গুরুজনের সান্নিধ্য নয়, বন্ধুবান্ধব, স্কুল কলেজ, কোচিং সেন্টার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, গুগল, নেটফ্লিক্স তাকে হাতছানি দেয়। এখন স্কুল কলেজ কোচিং ক্লাস সব বন্ধ। অন লাইন ক্লাস হলেও বন্ধুবান্ধব, মজা, ফুচকা, মোমো, জোকস কিচ্ছুটি নেই। বোরিং লাইফ। তার অপর বাবা-মা দু’ জনই বাড়িতে। সবসময় নজরদারি চলছে। ভালো লাগে? সঙ্গে রয়েছে টিভি নিউজের করোনাভাইরাস সংক্রমণ সংক্রান্ত ভয়াবহ বিবরণী। কেন যে সারাটা দিন চালিয়ে রাখে বাবা। খুব টেনশন হয়। ছোটদেরও মনের মধ্যে নানারকম চাপান উতোর চলে। তাদের ডিপ্রেশনটা আর গভীর।
একেবারে ছোট্টরাও ভালো নেই
অনেকে ভাবেন ছোটদের টেনশন হয় না। ডিপ্রেশন হয় না। এই ভাবনা একেবারে ভুল। তারা সবটা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারে না বলে মন খারাপ বেশি হয় তাদের। এই যে বাড়িতে সবসময় অসুখবিসুখ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে টিভিতে রাতদিন করোনাভাইরাস নিয়ে চর্চা চলছে এটা ছোটদের মন বিষণ্ণ করে তুলছে। বড়দের মতো তারাও প্রথমে লকডাউনকে ছুটি হিসেবে নিয়েছিল। বাবা-মা বাড়িতে থাকলে খুব মজায় কাটবে ভেবেছিল। কিন্তু এখন তারাও বুঝেছে এই ছুটিতে কোনও মজা নেই। বরং বাবা-মা সবসময় বাড়িতে থাকার ফলে এমন অনেক কিছুই সে করতে পারছে না যা আয়ামাসির কাছে থাকলে করতে পারে। বাবা-মায়ের নিজেদের মনও অবসাদগ্রস্ত। তাই তারাও সন্তানদের সঙ্গে ব্যবহারে ধৈর্য রাখতে পারছেন না। বকাবকি করছেন, মারধর করছেন। পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য টিকটিক করছেন। অন্যদিকে তারা স্কুলের বন্ধু, টিফিনের মজা, খেলাধুলো, আন্টিদের স্নেহ, ক্লাসরুম, এমনকী স্কুলে যাওয়ার পথটিকেও মিস করছে। অন লাইনে ক্লাস তাদের অভ্যাসে নেই। অথচ করতে হচ্ছে। তাই ছোটদের ছোট্ট মন অশান্ত ভারাক্রান্ত।
অবসাদ থেকে বেরনোর উপায় কী?
২৪দিন ২৪ঘণ্টা একটানা একসঙ্গে কাটানো কিন্তু খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। তার সঙ্গে আছে কাজকর্ম চাকরি অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে টেনশন। আর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আতঙ্ক। এই একঘেয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে গেলে মনকে শান্ত রাখতে হবে। জীবন থেকেই খুজে নিতে হবে আনন্দে থাকার উপাদান। মনোবিদ ডাঃ রিমা মুখোপাধ্যায় ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন আমাদের জন্য। ডিপ্রেশনের ১০ দাওয়াই —
১. রোজের রুটিন বদলাবেন না
লকডাউনের জন্য বাড়িতে রয়েছেন বলে যখন খুশি ঘুম থেকে উঠবেন, যতক্ষণ ইচ্ছে খাবেন, রাত জেগে সিরিজ বা সিনেমা দেখবেন, এমনটা করবেন না। বাড়ির কাউকে করতেও দেবেন না। শরীর ঠিক রাখা জরুরি।
২.পরিবারের প্রত্যেককে নিজস্ব স্পেস দিতে হবে
২৪ ঘণ্টা বাড়িতে একসঙ্গে কাটাতে আমরা অভ্যস্ত নই। তাই কর্তা গিন্নি বাড়ির বয়স্ক মানুষ এবং ছোটদেরও কিছুটা সময় নিজের মতো করে কাটাতে দিতে হবে। সবসময় সবার ব্যপারে ইন্টারফেয়ার করলে তর্ক হবে, মনোমালিন্য বাড়বে।
৩. যেসব বিষয়ে মতের অমিল হয় তা এখন তুলবেন না
কিছু বিষয় থাকে যা উঠলেই তর্কাতর্কি হয়। শুধু স্বামী-স্ত্রী র মধ্যেই নয়, বাবা-ছেলের মধ্যে হতে পারে, মা-মেয়ের মধ্যে হতে পারে, শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে হতে পারে। বন্দিদশায় এইসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া উচিত। উঠলেও একজন চুপ করে যাবেন। কারণ এই সময় ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বাড়ছে। মেজাজ হারিয়ে অনেকেই ভুল কাজ করে ফেলছেন।
৪. দিনের কোনও একটা সময় পরিবারের সবাই মিলে মজা করে কাটান
সবাই যখন বাড়িতেই আছেন তখন লাঞ্চ ডিনার একসঙ্গে করুন। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, বাড়ির কাজকর্ম, পড়া লেখার বাইরে এক দু’ ঘণ্টা সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে কাটান। লুডো দাবা ক্যারাম খেলতে পরেন, ভালো মুভি দেখতে পরেন, টিভিতে মজার শো দেখতে পারেন, না হলে নিছকই গল্প করে কাটান। মন ভালো হয়ে যাবে।
৫. সারাদিন টিভিতে নিউজ চালিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর শুনবেন না
এতে নিজের যেমন উত্তেজনা বাড়বে তেমনি বাড়ির বয়স্ক ও ছোটদের মনে আতঙ্ক জারিত হবে।
৬. হালকা করে গান চালিয়ে রাখুন
রবীন্দ্রনাথের গান বা ওয়েস্টার্ন মিউজিক যাই বাজান তা যেন মনকে শান্ত রাখে। উদ্দাম উত্তেজক কিছু বাজাবেন না।
৭ .বাড়ির কাজ ভাগ করে নিন
বিশেষ করে টিনএজার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে রান্না করুন, ঘর গোছানোর কাজ দিন। ওদের বোঝান পরবর্তীতে যখন বাইরের দেশে পড়তে বা কাজ করতে যাবে তখন এসব কাজে লাগবে। তাই এই সুযোগে শিখে নিতে হবে। দেখবেন ওরা মনের আনন্দে কাজে লেগে যাবে।
৮. ছোটদের স্মার্টফোন স্মার্টলি কাজে লাগাতে বলুন
সবসময় ফোন নিয়ে খুটখাট করছে বলে বকাবকি না করে এই অবসরে স্মার্টফোন থেকে পছন্দের কিছু শিখতে বলুন। সেটা স্পোকেন ইংলিশ হতে পারে, কুকিং হতে পারে কোনও বিশেষ স্কিল হতে পারে। এতে শেখাও হবে একটা আত্মতৃপ্তিও আসবে। মন ভালো হয়ে যাবে।
৯. নিজের ক্রিয়েটিভিটি পুনরুদ্ধার করুন
কাজের চাপে আপনার যেসব গুণ চাপা পড়ে গিয়েছিল তার চর্চা শুরু করে দিন। ফেব্রিক পেন্টিং, সেলাই, হাতের কাজ, কবিতা লেখা, আঁকা যার যা ভালো লাগত তাই করুন নতুন করে। অদ্ভুত একটা তৃপ্তি আসবে। গ্লানি মুছে যাবে।
১০. বাড়ির সবাই একসঙ্গে যোগ ব্যায়াম বা প্রাণায়াম করুন
দিনের যে কোনও সময় কুড়ি মিনিট যোগ আর প্রাণায়াম করুন। ডিপ্রেশন কাটানোর এর থেকে ভালো আর কোনও ওষুধ নেই।
সবশেষে বলি, বাড়িতে আছেন বলে একঘেয়ে বারমুডা বা নাইটি পরে কাটাবেন না। ছেলেরা অনেকে দেখছি শেভ করাই ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়েরাও ক্লামজিভাবে কোনও রকমে দিন কাটাচ্ছেন। এতে অবসাদ আরও বাড়ছে। পরিচ্ছন্ন থাকুন সেজেগুজে থাকুন। এতে মন ঝরঝরে হবে। ডিপ্রেশন দূরে যাবে।
মডেল : প্রীত ও পিয়ালী ছবি: প্রদীপ পাত্র
গ্রাফিক্স: সোমনাথ পাল