কর্মপ্রার্থীদের কোনও সুখবর আসতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদন্নোতির সূচনা। গুপ্ত শত্রু থেকে সাবধান। নতুন কোনও প্রকল্পের ... বিশদ
আজ সেই ঘটনার ৪২ বছর পরও আটাত্তরের বন্যার ত্রাণবিলি নিয়ে দেদার অভিযোগের কথা বেশ মনে আছে। মনে আছে, কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে বামেদের গলা ফাটানো প্রতিবাদের কথাও। তখন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বিরাটভাবে ভোটে জিতে আসা বঙ্গেশ্বর জ্যোতি বসু। তিনি একাই একশো। দলে কিংবা সরকারে তাঁর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। রাজ্য রাজনীতিতেও আর যাঁরা ছিলেন তাঁরা ব্যক্তিত্বে, জনপ্রিয়তায় ছিলেন জ্যোতিবাবুর তুলনায় অনেক খর্বকায়। কোনও প্রশ্ন তোলার, সস্তা টিপ্পনী কাটার সাহস ছিল না স্বভাবতই।
আজ সেই দুর্যোগের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সেদিনের প্রসঙ্গ তুলে বামপন্থী বন্ধুদের যদি প্রশ্ন করি, সেবার দুর্যোগের পরের সপ্তাহেই রাজ্য কি পুরোটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল? সর্বত্র মানুষ ত্রাণ শিবির থেকে ঘরে ফিরে গিয়েছিল, রাস্তাঘাট সব সারানো সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, জল, বিদ্যুৎ সব ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে এসেছিল? অতি বড় বাম সমর্থকও বোধহয় এর উত্তরে ‘না’ ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারবেন না। আর বঙ্গের বিজেপির নেতাদের ওই প্রশ্ন কখনও করব না, কারণ দলটারই তখন কোনও অস্তিত্বই ছিল না।
আজ চার দশকেরও বেশি সময় পরে আবার এক বিধ্বংসী মহাপ্রলয় কলকাতা-সহ গোটা দক্ষিণবঙ্গকে কাঁপিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। এমন শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় বাংলার মানুষ আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। দুপুর থেকে রাত কোথাও ১৫০ কিমি আবার কোথাও ১৩০ কিমি বেগে টানা ঝড়ের আছড়ে পড়া প্রলয়ের ক্ষয়ক্ষতি কোনও সরকারের পক্ষে একদিনে, এক সপ্তাহে কিংবা এক মাসেও পূরণ করা কি সম্ভব? কত যে গাছ আর বাতিস্তম্ভ উল্টে গিয়েছে, তার হিসেব এখনও চলছে। তার উপর গ্রামে বহু এলাকায় এখনও জল জমে আছে। ফলে কাজে দেরি হচ্ছে। মানুষের ক্ষোভ সঙ্গত হলেও এতবড় একটা দুর্যোগের পরের দিনই কেউ যদি মনে করেন, জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা সব ম্যাজিক করে মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করে দেবেন, তাহলে বলতে হয়, সমালোচকদের আর একটু দায়িত্বশীল হতে হবে। বিরোধীরা যাঁরা প্ররোচনা ছড়াচ্ছেন, তাঁদের একটু সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বাইরে বেরতে হবে।
মহামান্য নেত্রীর হাতে কোনও জাদুদণ্ড নেই যে তিনি ছুঁয়ে দেবেন, আর সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি সব আগের মতো হয়ে যাবে। প্রশাসন চালানো কোনও ভোজবাজি কিংবা মাদারি কা খেল নয়। এই পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন যজ্ঞ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এর জন্য একদিকে যেমন বিপুল অর্থ প্রয়োজন তেমনি জরুরি সুষ্ঠু পরিকল্পনার। দুর্যোগের পর পরই প্রধানমন্ত্রী এসে সামান্য হাজার কোটি টাকার অর্থসাহায্যের ঘোষণা করে ফিরে গিয়েছেন। বিজেপির বন্ধুরা কি জানেন, ঘোষণাই সার, এখনও কানাকড়িও মেলেনি। বুলবুলের ত্রাণ পেতে হিমশিম অবস্থার কথা মনে আছে তো!
তাহলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, বিপর্যস্ত এলাকাকে আবার গড়ে তোলা সম্ভব হবে কী করে? রাজ্য সরকারের আগের পাওনাই তো ৫৩ হাজার কোটি টাকা। আর এবারের ক্ষতি ১ লক্ষ কোটি টাকার উপর। তাহলে দেড় লক্ষ কোটি টাকার কাজ মাত্র এক হাজার কোটিতে সম্পূর্ণ হবে কী করে? তার উপর রয়েছে করোনা বিশ্বব্যাপী মহামারীর মোকাবিলা। সেখানেও শয়ে শয়ে কোটি টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অথচ দু’মাসের উপর লকডাউনে রাজ্যের ভাঁড়ে মা ভবানী হাল! কোনও আয় নেই, অথচ খরচ বাড়ছে। তবু হাল ছাড়তে রাজি নন হার-না-মানা জননেত্রী। রাজ্য কোষাগারের বর্তমান করুণ অবস্থা কারও অজানা নয়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো আগের সরকারের চাপিয়ে দিয়ে যাওয়া ঋণের বোঝা। তা সত্ত্বেও কালক্ষেপ না করে তিনি ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকার এক বিরাট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছেন দুর্গত মানুষের ত্রাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পুনর্গঠনে। কেন্দ্রের সাহায্যের তোয়াক্কা না করে মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগ কিন্তু বিশেষ প্রশংসার যোগ্য। মুখ্যমন্ত্রীর কট্টর সমালোচকদেরও উচিত, আপাতত আকচাআকচি আর রাজনৈতিক জমি দখলের রাজনীতি বর্জন করে একটু গঠনমূলক কাজ করা। একটু রাজ্যের কথা ভাবা।
ভুললে চলবে না, করোনা ও উম-পুন দুই কিন্তু শতাব্দীর অন্যতম বড় বিপর্যয়। দুটোর কোনওটাই সামান্য ঘটনা নয়। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বুক ভরা সাহস আর অদম্য জেদের বলেই এত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও সমানে সমানে লড়ে যাচ্ছেন। সামনে থেকে মোকাবিলা করছেন। তাঁর এই প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কুর্নিশ না করে উপায় নেই। শুধু সমালোচনা, কটাক্ষ, শ্লেষ মেশানো মন্তব্য না করে বিরোধীদের উচিত, রাজ্যের এই দুর্দিনে একটু সৌজন্যের পরিচয় দেওয়া। একটু সময় দেওয়া। এখন ভোট রাজনীতির সময় নয়, বাংলার মানুষের সামগ্রিক হিতের কথা মাথায় রেখে কাজ করতে হবে সবাইকে। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি কিছুদিন বন্ধ থাক না। আগে মানুষ বাঁচুক, খোলা হাওয়ায় নিশ্বাস নিক। শুধু উতোর-চাপান বা তর্জায় মানুষের তো কোনও লাভ হবে না। যাঁর বাড়ি ভেঙে গিয়েছে, যাঁর স্বজন মারা গিয়েছেন, তাঁর দরকার একটু মানবিকতা, একটু সহানুভূতি। অথচ সারা বিশ্ব দেখছে, এই কঠিন সময়েও বঙ্গ রাজনীতিতে আজ সৌজন্যের কতটা অভাব। মমতাকে রাজনৈতিকভাবে বিড়ম্বনায় ফেলতে বাংলার বদনাম করাকেই প্রধান কৌশল হিসেবে বেছে নেওয়া কেন? এই আত্মঘাতী রাজনীতি তো বাংলাকে, বাংলার মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলছে। পিছিয়ে দিচ্ছে।
এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। মানুষ কিন্তু সব দেখছে। করোনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যে মহারাষ্ট্রে, গুজরাতে, দিল্লিতে সেখানেও বিরোধীরা সরকারকে উঠতে বসতে এমনভাবে অপদস্থ করতে মরিয়া নয়। এই রাজ্যে করোনা পর্বে বিরোধীদের একটাই কাজ, যে কোনওভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে বিরক্ত করো, সব হিসেবকে ভুল প্রমাণ করো, সরকারকে আঘাত করো। কুৎসা ছড়াও। ব্যাস, তাহলেই কেল্লা ফতে। তাতে রাজ্যটার সর্বনাশ হলেও বিরোধীদের যেন কুছ পরোয়া নেই! সরকার পক্ষই হোক কী বিরোধী পক্ষ, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই মুহূর্তে রাজ্যের পরিস্থিতিটা কিন্তু ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জের।
একদিকে, রাজ্যের অর্থনীতি শিকেয়, অন্যদিকে, করোনা সংক্রমণ রুখতে ঘরে ঘরে চেপে বসা আতঙ্ক। তার উপর মহারাষ্ট্র, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশের মতো কার্যত করোনার রেড জোন থেকে ট্রেন বোঝাই করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা, এসব নিয়ে যখন পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর, ঠিক তখনই ঘূর্ণিঝড়ের উন্মত্ত প্রলয় নাচন আরও বড় ক্ষতি করে দিয়ে গেল। একদিকে করোনা সামলাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ, আবার সেই মানুষেরই ছাদ হারিয়ে ত্রাণ শিবির, স্থানীয় স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, এই দুই পরস্পর-বিরোধী অবস্থান একসঙ্গে চলতে পারে না। অথচ সেই অসাধ্য সাধনই করতে হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন বাংলার সরকারকে। তার মধ্যেও এই কঠিন অবস্থার মোকাবিলা করে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের আশি শতাংশ এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে।
তাই একটাই আবেদন সবার কাছে, রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে বাংলাকে দয়া করে হারিয়ে দেবেন না। পাশে দাঁড়ান।