সপরিবারে নিকট ভ্রমণের পরিকল্পনা। সহকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে শত্রুতা করতে পারে। নতুন কোনও কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মক্ষেত্রে বদলির ... বিশদ
প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা, দেখা যাচ্ছে, ভুলে ভরা ছিল। তথাকথিত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই কোথাও হয়নি। এমনকী বহুচর্চিত সাতটি ‘সুইং’ প্রদেশও ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে এবং একতরফাই ঝুঁকল:
এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে দু’পক্ষের জয়-পরাজয়ের ব্যবধানটিও পাওয়া গেল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট আগেইন) মানে কী
বেশিরভাগ স্বাধীন পর্যবেক্ষক এবং নিরপেক্ষ মিডিয়া একমত যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার এবং তাঁর ভাষণগুলি ছিল অশালীন, বর্ণবিদ্বেষপূর্ণ, অপমানজনক এবং বিভেদমূলক। কিন্তু আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাঁর এই নেতিবাচক ভূমিকাকে পাত্তাই দেয়নি। তারা বরং গুরুত্ব দিয়েছিল এবং বেশি ভাবিত ছিল অভিবাসন, মুদ্রাস্ফীতি এবং অপরাধমূলক কাজকর্ম নিয়ে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে নাগরিকের জীবনযাত্রা নিশ্চয় জড়িত। কিন্তু বাকি দুটি আমাদের ‘রুটিরুজি’র মতো কোনও জরুরি সমস্যা নয়। ওই সমস্যা দুটিকে মোটামুটিভাবে মরাবাঁচার চেতাবনি হিসেবে দেখা যেতে পারে। অভিবাসনকে ‘আমাদের মতো নয় এমন লোকেদের’ জন্য দরজা হাট করে খুলে দেওয়ার মতো বিপদ হিসেবে দেখা হয়, যাতে শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান আমেরিকান নাগরিকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি যাচ্ছে। এমনকী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগে প্রবেশাধিকার পেয়ে যাওয়া অভিবাসীদের কাছেও নতুন অভিবাসীরা স্বাগত গণ্য হয়নি। বিশেষত লাতিন আমেরিকা বংশোদ্ভব পুরনো ভোটাররা নতুন অভিবাসীদেরকে তাদের জন্য বিপদ হিসেবেই দেখছে। মুদ্রাস্ফীতি প্রতিটি দেশের সকলকেই দুর্ভোগে ফেলেছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ২.৪ শতাংশের গণ্ডিতে থাকা সত্ত্বেও মার্কিন ফেড সুদের হার নীতিগতভাবে কমাতেও প্রস্তুত। ব্যাপারটিকে নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির লক্ষণ হিসেবেই দেখা উচিত। তবুও এই মুদ্রাস্ফীতিই, নির্বাচনী প্রচারে রিপাবলিকান পার্টির হাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ণ এবং মাদকের রমরমার কারণে বেশিরভাগ দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অপরাধ বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে। অপরাধ, যেকোনও শাসককের জন্য সবসময়ই এক মারাত্মক বিপদ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ইস্যুগুলির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন। আর এই ইস্যুতে আক্রমণের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন অনবদ্য ট্রাম্পসুলভ অশালীন বা কুরুচিকর ভাষা প্রয়োগের রাস্তা। আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে যে, ভোটাররা এসব অকথা-কুকথাকে গায়েই মাখেননি!
লুপ্ত সংযম ও শালীনতা
অন্যদিকে, প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন গর্ভপাত এবং মহিলাদের অধিকার, সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষা, সবার জন্য ন্যায়, জাতিগত সমতা এবং সহানুভূতির মতো বিষয়গুলির উপর। কিন্তু পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করা গেল যে, তাঁর প্রচারের প্রধান বিষয়গুলি বেশিরভাগ ভোটারকে নাড়া দেয়নি। যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই মূল্যবোধগুলির প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাও নেই, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে এগুলির পরাজয় হয়েছে।
মার্কিন নির্বাচনে ‘পরাজয়’ হয়েছে আরও যেসব বিষয়ের, তার মধ্যে থাকছে প্রায় ৪৪ হাজার ফিলিস্তিনি মানুষের (তাঁদের মধ্যে ছিলেন কয়েক হাজার নারী ও শিশু এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্মী) নির্মম হত্যার ঘটনার। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার হামলা মার্কিন জনমানসকে তেমন একটা আন্দোলিত করতে পারেনি। তাইওয়ানকে চীনের হুমকি, উত্তর কোরিয়া তাদের দূরপাল্লার আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলে আমেরিকার মাটিতে আঘাত হানতে পারে, অনেকগুলি দেশে গৃহযুদ্ধ এবং একাধিক তথাকথিত গণতন্ত্রে স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতার ইস্যুগুলি আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষকে নাড়া দেয়নি। বেশিরভাগ ভোটার মনেই রাখেননি যে তাঁরা ভোট দিচ্ছেন—এবং অবশেষে নির্বাচিত করতে চলেছেন এমন একজনকে, যিনি ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত এবং অপেক্ষা করছেন শাস্তি ঘোষণার জন্য! এবার দেখা যাক তাদের অর্থনীতির দিকটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ করে তুলেছে তাদের যে নীতি (ফ্রি অ্যান্ড ওপেন ট্রেড, শুল্কের নিম্নহার, অ্যান্টি-মনোপলি) তার থেকে সরে আসাকেও সে-দেশের জনগণ তেমন গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয় না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় নিয়ে উল্লসিত ‘ইকনমিক প্লেয়াররা’ হল —বিগ অয়েল, বিগ ফার্মা এবং বিগ টেক—অর্থাৎ তেল, ওষুধ এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রের দানবতুল্য কর্পোরেটরা।
লিঙ্গ এবং রং
শেষাবধি, আমেরিকান ভোটাররা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছেন। পুরুষ ভোটাররা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন। ১৮-২৯ বছর বয়সি বা তরুণদেরও পছন্দের প্রার্থী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। শ্রমিক শ্রেণির ভোটাররাও তাঁকে চেয়েছেন। নন-গ্র্যাজুয়েট বা অল্প শিক্ষিত ভোটাররা ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে। ল্যাটিনো ভোটাররা (মেক্সিকো, পুয়ের্তো রিকো এবং কিউবার থেকে আসা) ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পছন্দ করেছেন। কোনও ভণিতা না রেখে এটাই বলতে হয় যে, তাঁরা সকলেই কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। ভোটদাতাদের এই পছন্দ-অপছন্দের জন্য বিচার্য হয়েছে মূলত প্রার্থীর লিঙ্গ এবং ত্বকের রং।
মার্কিন নির্বাচনের ফলাফল অন্যান্য দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে কি না সেটাই আজকের ভাবনার বিষয়। ওরা পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপুল বিজয়—রূঢ় ভাষা এবং বিভাজনমূলক ভাষণ অনুকরণে, অন্যান্য দেশের নেতাদের প্ররোচিত করতে পারে। কেননা, এই নিন্দনীয় রাজনীতিই এবার আমেরিকার নির্বাচনে সফল হয়েছে। ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প মডেল’ অন্য দেশগুলিতে সংক্রামিত হলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য একটি মারাত্মক ধাক্কা।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত