কৃষিজ পণ্যের ব্যবসায় উন্নতি ও লাভ বৃদ্ধির যোগ। সাহিত্যচর্চা/ বন্ধু সঙ্গে আনন্দ। আর্থিক উন্নতি হবে। ... বিশদ
২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে এহেন এক অবস্থায় কংগ্রেস ভোটের মাঠে নামার আগে শেষ মরিয়া চেষ্টা করছে। তারই একটি অঙ্গ হল একটা কোনও অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি করা। ততদিনে গ্রে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সংস্থার সঙ্গে বিজেপির চুক্তি হয়ে গিয়েছে। তাদের প্রথম দফার বিজ্ঞাপন পুরোদমে গ্রাস করে ফেলেছে দেশের মিডিয়া এবং জনমন। ঠিক এরকম সময় লিও বার্নেট সংস্থার ওই বিজ্ঞাপনী প্রেজেন্টেশন পছন্দ হল কংগ্রেসের। কিন্তু আটকে গেল পরের বৈঠকে। ৭ ফেব্রুয়ারি। কংগ্রেসের ট্রেজারার মতিলাল ভোরা বললেন, ৮০ কোটি টাকা দেওয়া যাবে না। অর্ধেক করতে হবে। কীভাবে সম্ভব? প্রস্তাব দেওয়া হল, বিজ্ঞাপনের প্রথম পর্ব বাদ দেওয়া হোক। কী ছিল লিও বার্নেটের বিজ্ঞাপন? দুটি পর্বে। প্রথম পর্বে বলা হবে, ‘আম আদমি কো কেয়া মিলা?’ অর্থাৎ ইন্ডিয়া শাইনিং তো বুঝলাম! আম আদমি কী পেল? আর ভোট শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আসবে দ্বিতীয় পর্ব। ‘কংগ্রেস কা হাত আম আদমি কে সাথ’। লিও বার্নেট সংস্থার ক্রিয়েটিভ টিম কিছুতেই মানবে না সেই প্রস্তাব। তারা বলল, ‘আম আদমি কো কেয়া মিলা’ এটা না থাকলে এই বিজ্ঞাপনের প্রভাবই থাকবে না। আমরা বলতে চাইছি, ইন্ডিয়া শাইনিং কাদের জন্য? আম আদমির তো কিছুই মেলে না। তাহলে আম আদমির কথা কে ভাববে? কংগ্রেস ভাববে। কংগ্রেসকে ভোট দিন। এভাবেই সাজানো হয়েছে স্লোগান। অতএব ওটা রাখতেই হবে।
একটি বই প্রকাশিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। সেই বইয়ের নাম, ‘ডোন্ট ফরগেট ২০০৪: অ্যাডভার্টাইজিং সিক্রেটস অফ অ্যান ইমপসিবল ইলেকশন ভিকট্রি’। সেই বইতে লেখক লিও বার্নেটের অন্যতম ডিরেক্টর জয়শ্রী এম সুন্দর লিখেছেন, ৯ ফেব্রুয়ারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর সামনে রেডিও ক্যাম্পেন শোনানো হল আবার। একই কন্টেন্ট। প্রিয়াঙ্কা বললেন, আপনারা কি সব প্রস্তুতি করে ফেলেছেন? লিও বার্নেট বলল, না। আমাদের তো কাটছাঁট করতে বলা হয়েছে। প্রিয়াঙ্কা বলেছিলেন, ইটস অল অর নাথিং! অর্থাৎ হয় সবটা যাবে। নয়তো যাবেই না। প্রিয়াঙ্কার ওই সবুজ সংকেতের পর আর বাধা নেই। শুরু হল বিজ্ঞাপনের যাত্রা। অবিশ্বাস্য এক ফলাফল হয়েছিল। বিজেপি হেরে যায়।
বিজেপির ২০২৪ সালের বিজ্ঞাপনে ডাবল ইঞ্জিন সুবিধা আছে। একদিকে সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ কমিউনিকেশন। তারা সরকারি টাকায় মোদি সরকারের হয়ে বিজ্ঞাপন করছে। মোদি সরকারের গ্যারান্টি শীর্ষক। আবার পাশাপাশি বিজেপির ভোট প্রচারের বিজ্ঞাপনের কন্ট্রাক্ট পেয়েছে মূলত ম্যাকান ওয়ার্ল্ড গ্রুপ এবং স্কারক্রো এম অ্যান্ড সি। ম্যাকান ওয়ার্ল্ড গ্রুপের কর্ণধার হলেন বিখ্যাত কবি, গীতিকার প্রসূন যোশী। মোদি সরকার এবং বিজেপির প্রিয়পাত্র তিনি। অসংখ্য সুপারহিট গান ও সিনেমার গীতিকার তথা চিত্রনাট্যকার। বিজ্ঞাপনী জিঙ্গল ও গানেও তিনি সফল এবং দক্ষ। অন্যদিকে, মোদির অমৃতকাল এবং মোদির গ্যারান্টি স্লোগানের বিপরীতে পাল্টা প্রচারের জন্য কংগ্রেস বেছে নিয়েছে ডিডিবি মুদ্রা নামক বিখ্যাত এজেন্সিকে। কারা এরা? দীর্ঘকালের সমীহ সৃষ্টিকারী অ্যাড সংস্থা। যাদের বিখ্যাত তথা আইকনিক বিজ্ঞাপনী ক্যাচলাইন হল, ‘অনলি বিমল’ অথবা ‘কেরালা, গডস ওন কান্ট্রি’। ডিবিডি মুদ্রার ক্লায়েন্ট তালিকা ঈর্ষণীয়। ম্যাকডোনাল্ড, নেটফ্লিক্স, ধারা, ফোকসওয়াগন, রয়্যাল এনফিল্ড ইত্যাদি।
এবারও কংগ্রেস ২০০৪ সালের ফর্মুলায়
ফিরে গিয়েছে। অন্তত আগ্রাসী বিজ্ঞাপনে তেমনই দেখা যাচ্ছে। মোদির অমৃতকালে যে আম আদমি
কিছু পায়নি, বেকারত্ব থেকে মূল্যবৃদ্ধির জেরে আম আদমি জেরবার, সেটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতিটি অডিও ভিস্যুয়াল অথবা প্রিন্ট কিংবা ডিজিটাল প্রচারে। কংগ্রেসের এবারের স্লোগান হল, ‘হাত বদলেগা হালত’।
২০০৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল ২০ বছর এগিয়ে এসেছে। বিজ্ঞাপনের অভিমুখ এবং টার্গেট অডিয়েন্সও বদলে গিয়েছে। তাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ক্যাম্পেনের জন্য সব দলের বাজেট রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। একটি হিসেবে দেখা গিয়েছে গুগুল অ্যাডস খাতে অর্থাৎ গুগুল ২০১৮ সাল থেকে যে বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু করেছে তাদের প্ল্যাটফর্মে, তার ২৬ শতাংশই বিজেপির। ১০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে গিয়েছে বিজেপির ক্যাম্পেনে শুধু গুগুলে। পূর্বতন বিজ্ঞাপনের সঙ্গে ২০২৪ সালের বিজ্ঞাপনী স্ট্র্যাটেজি এবং থিওরির পার্থক্য কী? পার্থক্য হল, আগে টিভিতে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন দেখা ছিল ব্যক্তিগত দর্শন ও শ্রবণ। দেখলাম, শেষ হয়ে গেল, ভুলে গেলাম অথবা মনে রাখলাম। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বর্তমান জগতে পছন্দ হলে সেই বিজ্ঞাপন শেয়ার করার সুবিধা আছে। অর্থাৎ একটি বিজ্ঞাপনের একজন ভিউয়ার সেটা শেয়ার করে করে আসলে নিজের অলক্ষ্যেই একজন ক্যাম্পেনারও হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে এখন ডিজিটাল ক্যাম্পেন এত গুরুত্বপূর্ণ। যে ওই ভিডিও অথবা প্রচারের স্লোগানটি শেয়ার করছে বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা গ্রুপে, সেজন্য সে কিন্তু কোনও টাকা পয়সা পাচ্ছে না। ভোটের পরও সে যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। অথচ সে একজন পরোক্ষ প্রচারক। ওই বিজ্ঞাপনের সংস্থা হাজার হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ভোটাররা যে দলকে জেতাবে, তারা সিংহাসনে বসবে। হাজার হাজার কোটি টাকা দলের ফান্ডে আসবে ক্ষমতাসীন হলে। কিন্তু ভোটারদেরও জীবন পাল্টায় না। এসব সবাই জানে।
সব দলের এই যে প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ, একটি বা একাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিরা ভোটারদের কাছে তাদের ক্লায়েন্টদের সম্পর্কে ভালো ভালো চিত্র ও স্বপ্ন নিয়ে আসবে এটা স্বাভাবিক। রাজনীতি এবং ভোট যে সংসদীয় গণতন্ত্রের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আবার এটাও ঠিক যে, এই গোটা প্রক্রিয়া একটি বৃহৎ বিজনেস। ‘ইলেকশন ইকনমি’ ভারতে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার একটি বাণিজ্য। সুতরাং এটা মাথায় রেখে আমাদের ভাবতে হবে যে,আমরা যারা এই ইলেকশন ইকনমির প্রত্যক্ষ অংশীদার নই, তারা ভোটটা কীভাবে দেব? নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে? নাকি প্রচার ও প্রোপাগান্ডায় আকৃষ্ট হয়ে? কোন দল আমাদের কী কী সুবিধা দিচ্ছে। সরাসরি নিজের স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছে। আমাদের সংসারের কাজে লাগছে। পরিবারের সামান্য কিছু সুরাহা হচ্ছে। আর্থিক সাশ্রয় হচ্ছে অথবা হতে পারে। এসব ভেবেই কি ভোট দেওয়া উচিত নয়? সেটাই কি বুদ্ধিমত্তা নয়? নাকি নিছক দলীয় মতবাদের ক্রীতদাস হব?
নবীন পট্টনায়ক কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের প্রধান ভোটব্যাঙ্ক হলেন মহিলারা। তাঁরা দুজনেই মহিলাদের ভোট পেয়ে থাকেন। প্রধানত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। নবীন পট্টনায়কের মহিলা ভোটব্যাঙ্কের কারণ হল, মিশন শক্তি প্রকল্প। মহিলাদের স্বনিযুক্তি স্কিম। বিনা সুদে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয় ব্যাঙ্ক লোন। এবং বিজু স্বাস্থ্য কল্যাণ যোজনা। ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিমা। একইভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী এবং স্বাস্থ্য সাথী ইত্যাদি প্রকল্পে মহিলা ভোটব্যাঙ্ক অটুট। এই দুই উদাহরণ দেওয়ার অর্থ হল, এই মহিলা ভোটব্যাঙ্ক কিন্তু ঘর পরিবার থেকে অনেক দূরে কোথায় মন্দির মসজিদে কী হয়েছে, কোথায় কোন সম্প্রদায় কোন গোষ্ঠীকে মারধর করেছে, কোনটা ফেক নিউজ, এসব ভাবেই না। রোজকার মোমেন্টারি ইস্যুতে তারা মাথাই ঘামায় না। তারা ভাবে নিজেদের পরিবারের কথা। সুবিধার কথা। সুরাহার কথা। আবার মোদি যতই হিন্দু মুসলিম নিয়ে বিভাজনের চেষ্টা করুন, সেভাবে বিরাট লাভ দিচ্ছে না। তাঁর অন্যতম ভোটব্যাঙ্ক হল কেন্দ্রীয় প্রকল্পের লাভার্থীরা। অর্থাৎ বিনামূল্যে রেশন, আবাস যোজনা, কৃষকদের ৬ হাজার টাকা ইত্যাদি। অর্থাৎ সমাজের এই যে তথাকথিত নিম্নবর্গ এবং নিম্নবিত্ত অংশ, তারা সরাসরি সুযোগ সুবিধাকে প্রধান্য দিচ্ছে। প্রোপাগান্ডায় খুব একটা গা ভাসায় না। এটা কি সুবিধাবাদী ভোটব্যাঙ্ক? নাকি বাস্তববাদী পরিণতমনস্কতা? কোনটা ঠিক?