শুভ যোগাযোগ ও পরিকল্পনায় কাজকর্মে উন্নতি। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান। ... বিশদ
বহুত হো চুকা হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই।’
হিন্দুত্ববাদীদের জন্য এই ‘ভক্তিমূলক’ গান রচেছেন প্রেম কৃষ্ণবংশী। যার বাংলা তর্জমা: ‘তুমি মানুষ নও, তুমি কসাই; যথেষ্ঠ হয়েছে হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই।’ বিদ্বেষমূলক রাজনীতির টানে কৃষ্ণবংশীর এই গান এখন গোবলয়ে নতুন গণসংস্কৃতির অংশ।
উত্তরপ্রদেশের লখনউ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক প্রেম কৃষ্ণবংশী বলিউডের গায়ক হতে চেয়েছিলেন। বলিউডে ঠাঁই না পেয়ে বেছে নেন লাইভ শো এবং স্টেজ শো। তাঁর সঙ্গীত কেরিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ২০১৪ সালে। দেশে বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর। সামাজিক মেরুকরণে সঙ্গীতও সাংস্কৃতিক পণ্য হয়ে ওঠে। ঘৃণার রাজনীতি বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে প্রেম কৃষ্ণবংশীদের গান। সম্প্রতি, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের প্রশংসা করে গান গাওয়ায় উত্তরপ্রদেশ সরকার কৃষ্ণবংশীকে সেরা গায়কের পুরস্কারও দিয়েছে।
রাজনৈতিক হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে শক্তপোক্ত করতে কৃষ্ণবংশী হিন্দি এবং ভোজপুরি ভাষায় গান করেন। তাঁর ভক্তরা মূলত গোবলয়ের। সাম্প্রদায়িকতার সুর চড়িয়ে কৃষ্ণবংশী কখনও তাঁর গানে বলেছেন, মুসলিমরা ‘দেশবিরোধী, তাদের পাকিস্তানে যাওয়া উচিত।’ কখনও বলেছেন, ‘মুসলিমরা শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের নমাজ পড়তে বাধ্য করবে যদি তারা তাড়াতাড়ি না জাগে।’ ‘হাম বচ্চে খুব বনায়েঙ্গে/ যব সংখ্যা হুয়ি হামসে জাদা/ ফির আপনি বাত মানায়েঙ্গে।’ সংবাদসংস্থা আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কৃষ্ণবংশী বলেছেন, ‘আমার গান সত্যকে নির্দেশ করে এবং যদি কেউ মনে করে যে এটা ইসলাম বিদ্বেষী, তাহলে আমি তাদের সেই অনুভূতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি না।’ কৃষ্ণবংশী একা নন, ‘চরম হিন্দুত্ববাদী’দের পক্ষে কথা বলে চলেছেন তাঁর মতো আরও অনেক ‘দেশপ্রেমী’ গায়ক-গায়িকা। এবং শ্রোতার সোৎসাহ-সমর্থন বুঝিয়ে দিচ্ছে এই কথাগুলি শোনার জন্য যেন উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত।
রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা যে আধুনিকতায় দেশকে দীক্ষিত করে গিয়েছেন, তাকে উপেক্ষা করে বিংশ শতাব্দীর প্রায় মাঝখানে এসেও তথাকথিত সনাতনপন্থী ভারতীয়রা ভিন্ন মতের মানুষকে ‘বিধর্মী ও বেজাত’ আখ্যা দিয়ে বিশুদ্ধতা রক্ষায় সচেষ্ট! অথচ, স্বাধীন ভারতের রূপকাররা সনাতন পরম্পরা সূত্রেই চেয়েছিলেন আধুনিক ভারত হবে জাতি-বর্ণ-ধর্মের ঊর্ধ্বে, এক মিলনক্ষেত্র। বহুত্বের মধ্যে একত্বই হল ভারতীয়ত্ব, বিবিধের মাঝে মিলনই হল তার সনাতন সুর। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারততীর্থ’ কবিতায় নানা দেশ জাতি সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের এই ভূমিতে এসে একত্রবাসের কথা বলেছেন। অথচ, সনাতন ভারতের একটি সঙ্কীর্ণ ধারণাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদের সপক্ষে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার হিড়িক জাগিয়ে তুলতে ডিজে-সহযোগে চলছে হিন্দুত্ব-পপ বা এইচ-পপ গান। ইউটিউবে ছড়িয়ে দেওয়া ঘৃণার বিষ, প্রকাশ্য হিংসার ইন্ধনকে ক্রমশ আরও সহজ, অতি স্বাভাবিক করে তুলছে। রামনবমীর মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি, কপালে তিলক, হাতে বিভিন্ন আকৃতির অস্ত্র নিয়ে উন্মত্ত মানুষের স্রোতের সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজে (ডিস্ক জকি)-সহযোগে বেজে চলা উদ্দাম গানের আওয়াজ। যে গানের ছত্রে ছত্রে সংখ্যালঘু, দেশের শাসক দল ও সঙ্ঘ পরিবারের বিরোধীদের উদ্দেশে নগ্ন ঘৃণা-ভাষণ। এই গানেই অভিবাদন জানানো হয় নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথদের। সুর তোলা হয় হিন্দু রাষ্ট্রের!
ধরুন, লক্ষ্মী দুবের কথাই। মধ্যপ্রদেশের শহর ভোপালের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। প্রয়াত পিতামহের কাছ থেকে হিন্দু ভক্তিমূলক গান শুনে বড় হয়েছেন। একটা সময় স্কুলের অনুষ্ঠানে মুসলিম-হিন্দু ভ্রাতৃত্ব এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের গান গাইতেন। ৩১ বছরের লক্ষ্মী দুবের কর্মজীবন শুরু একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে রিপোর্টার হিসেবে। কিন্তু, কৃষ্ণবংশীর মতোই ২০১৪ সালে মোদি জমানার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মীর জীবনও বদলে গিয়েছিল। লক্ষ্মী এখন দুই ধর্মের ভ্রাতৃত্বের নয়, ‘হিন্দুত্ববাদী পপ সঙ্গীত’ গেয়ে গেরুয়া শিবিরের কাছে বেশ জনপ্রিয়। আজ লক্ষ্মী দুবে শোনান: ‘আগার হিন্দুস্তান মে রেহনা হোগা, তো বন্দে মাতরম কেহনা হোগা’। লক্ষ্মীর মতো আরও এক পপ-তারকা কবি সিংয়ের গানও এখন হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদীদের নতুন অস্ত্র। মাত্র ২৫ বছর বয়সে কবি সিং ৮০টি গান রেকর্ডিং করে ফেলেছেন। লাভ জিহাদ থেকে হাইপার দেশপ্রেম— প্রতিটি গানই গেয়েছেন হিন্দুত্ববাদী ‘টকিং পয়েন্টে’। ‘অগর ছুয়া মন্দির তো তুঝে দিখা দেঙ্গে...।’ আসলে ভোটমুখী ভারতে সংখ্যালঘু বিরোধিতাকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে নবতম সংযোজন এই হিন্দুত্ববাদী পপ মিউজিক। সেখানে কদর্য তো বটেই, রীতিমতো হিংস্র ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের। এর মধ্যে কোনও ধর্মসাধনা বা ধর্মবেদনা নেই, আছে কেবল নির্বাচন-পূর্ব হিন্দু ভোটব্যাঙ্কসেবা। ধর্ম ও রাজনীতির এই যুগপৎ কলুষভার দেখে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের মাথা আজ হেঁট হয়ে যায় গভীর লজ্জায়, তীব্র উদ্বেগে।
সাংবাদিক শাবিনা আখতারের কথায়, শেক্সপিয়রের নাটক টুয়েলফথ নাইট-এ একটি সংলাপ ছিল ‘সুর যদি ভালোবাসার রসদ যোগায়, তবে বাজাতে থাকো, বাজাতে থাকো, বাজাতেই থাকো।’ কিন্তু ভালোবাসার বদলে যদি সেখানে জায়গা নেয় ঘৃণা? ঘৃণার খোরাক জোগায় যে গান, সে গানেরও তালে তালে মাথা দোলানোর উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন ভারতের নাগরিকদের। ধীরে ধীরে। কিন্তু বিরামহীনভাবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা যাঁদের এখনও বিব্রত করে, তাঁরা সভয়ে দেখছেন এই বর্বরতা। জন্ম দেওয়া হচ্ছে এক নতুন সংস্কৃতির, যেখানে গান-কবিতা-বইয়ের মত উপাদানগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিভাজনকে আরও বাড়িয়ে দিতে। মিছিলে বা জমায়েতে এইসব সাম্প্রদায়িক প্ররোচনামূলক গান, কবিতা, বা বইয়ের পাঠ হিংসা ছড়াচ্ছে, ঘনিয়ে তুলছে দাঙ্গা পরিস্থিতি।
এই বিষাক্ত সংস্কৃতিতে ভর করেই গোবলয়ে বিজেপি ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সেই মাটিতে সঙ্ঘ-পরিবারের অসংখ্য শাখাপ্রশাখা জনসংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশলে ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে গণসম্মতি গড়ে তুলছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুণাল পুরোহিতের লেখা বই ‘এইচ-পপ: দ্য সিক্রেটিভ ওয়ার্ল্ড অব হিন্দুত্ব পপ স্টারস’ পড়ুন। কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গান, কবিতা, বই বা পুস্তিকা সাম্প্রদায়িক ঘৃণাকে পুষ্ট করছে, কুণাল তার একের পর এক নজির তুলে ধরেছেন। এই সস্তা ইন্টারনেটের যুগে সামাজিক মাধ্যমগুলিকে ব্যবহার করে গেরুয়া শিবির কীভাবে মানুষের মগজে গেঁথে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী পপ সঙ্গীত, জনপ্রিয় কবিতা। জেএনইউ-র অধ্যাপক ব্রহ্ম প্রকাশের কথায়, ‘‘বিদ্বেষের সঙ্গীত ভারতে ধর্মীয় হিংসার ধরণ বদলে দিয়েছে। আমরা ভারতে দাঙ্গা ও গণহত্যার ঐতিহাসিক নিদর্শন জানি— নেতা ভাষণ দেন এবং দাঙ্গা রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই ধরণ বদলে গিয়েছে। আজ আর নেতার প্রয়োজন নেই। দরকার শুধু ‘ভক্তি ভাইব্রেটর।’ আপনি শুধু ডিজে বাজান এবং ডিজে সেই কাজ করে দেবে। জনতাকে প্ররোচিত করবে। হিংসা উস্কে দেওয়ার জন্য আপনার কোনও প্ররোচকের প্রয়োজন নেই। আপনি সুর ও গান ঠিক করে দেবেন, ব্যস বিদ্বেষ সব কাঁপিয়ে দেবে।’’
অথচ ভারতীয় সঙ্গীত চিরকালই সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করা শক্তির জন্যই আদৃত হয়ে এসেছে। আর তাই আজও ফরিদ আয়াজ ও আবু মোহাম্মেদের সুরে ও বাণীতে ইষ্টের প্রতি বিস্মিত ভক্তের অভিমান রেণু রেণু ঝরে পড়ে। ‘এ কানহাইয়া, ইয়াদ হ্যায় কুছ ভি হমারি?’ ‘পুরোহিতকে শতবার জিজ্ঞাসা করেও তোমার কোনও খবর পাই না কানহাইয়া, তুমি কি ভুলে গেলে আমাকে!’ ইষ্টের খবর আর যেই রাখুক মোল্লা অথবা পুরোহিত রাখবে না— এই বিশ্বাস থাকলে তবেই না ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে এই গান গাওয়া যায়। এভাবেই ধর্ম প্রাচীরকে গুঁড়িয়ে দিয়ে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের রচিত সঙ্গীত কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন, ‘অন্য ধর্মের ঈশ্বরের’ স্তুতিগানে মুখর হয়েছেন। এইভাবে বহুত্ব এসে মিলেছে একে, অথবা উল্টোটা এবং বহুত্ববাদ এবং সহিষ্ণুতায় আমাদের বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে।
ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সেই কবেই লিখে গিয়েছেন পণ্ডিত ভাস্কর রাওয়ের কথা। অমৃতসর ও জলন্ধরে মুসলিম শ্রোতাদের অনুরোধে উনি গাইতেন ‘হজরত খ্বাজা সঙ্গ খেলিয়ো হমার।’ যখন গান শেষ হতো আপ্লুত শ্রোতাদের ছোড়া ফুলে স্তূপ হয়ে যেত পণ্ডিতজির পায়ের উপর। আবার হিন্দু ভক্তদের অনুরোধে তাঁকে একই অনুষ্ঠানে গাইতে হতো ‘গোপাল মেরি করুণা’। প্রথম গানে বিহ্বল শ্রোতারা পণ্ডিতজির হাঁটু ছুঁয়ে কদমবুসি করলে, দ্বিতীয় গানের শেষে তাঁর সামনে ঢের লেগে যেত সাষ্টাঙ্গ প্রণামের। মুসলিমরা তাঁকে ভাবতেন পীর, হিন্দুরা সাক্ষাৎ সরস্বতীর সন্তান।
মোদির ভারত থেকে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় সঙ্গীতের সেই বহুত্ববাদ-সম্প্রীতির ঘরানা।
নয়া ভারতে সঙ্গীত-ও হয়ে উঠেছে ঘৃণার খোরাক!