বিদ্যার্থীদের মানসিক উদ্বেগ বৃদ্ধি পাবে। পঠন-পাঠনে আগ্রহ কম থাকবে। কর্মলাভের সম্ভাবনা আছে। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
শুধু এবারই নয়, একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এনিয়ে টানা পাঁচ বছর দেশে এই অবস্থা চলছে। কাজেই এবার বৃষ্টি চাই, নইলে চাষ বাঁচবে না, বাঁচবে না কৃষক। আব্বাসউদ্দিনের ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে গানের মত সেই কোন আমল থেকেই আমাদের দেশের কৃষকরা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছেন। বৃষ্টিতে তাঁরা বাঁচেন, অনাবৃষ্টিতে তাঁদের ঘরে ওঠে হাহাকার রব। গ্রামভারতে এই সরল সত্যের এখনও কোন পরিবর্তন হয়নি। ভালো বৃষ্টি মানেই চাষিদের ভালো আয়। মনে রাখতে হবে কৃষি কিন্তু এখনও দেশের বৃহত্তম ব্যক্তিগত উদ্যোগ। শুধু আমাদের দেশেই নয়, একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সারা পৃথিবীতেই কৃষকরা একমাত্র উৎপাদক। এ এমন একটা উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে কৃষককে নিজেকেই সবটা করতে হয়, সে তাঁরা ট্র্যাক্টর চালান বা হাল। বাকি সবকিছুই তো তৈরি হয় কারখানায়।
তবে এখন তো দিনকাল একটু অন্যরকম। এখন বর্ষা আর কৃষকদের আয় নির্ধারণ করছে না কিংবা বলতে পারছে না তাঁরা তাঁদের বহু পরিশ্রমের উৎপাদিত ফসলের কতটা দাম পাবেন সে কথা। গত বছরের কথাই ধরুন না, কৃষকরা এমন ফসল ফলিয়েছিলেন যা এর আগে কোনও বছর হয়নি। কিন্তু সরকারি রেকর্ড বলছে সেই অনুপাতে তাঁদের আয় বাড়েনি বরং তাঁদের আয় কমে গিয়েছিল। শুধু গত বছরই নয় এ নিয়ে পরপর তিন বছর তাঁদের আয় কমেছে। চাষবাসের সঙ্গে কৃষির একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে বলে বর্ষার আগমনে আশা জাগাটা এখন তাঁদের কাছে নেহাতই একটা অভ্যাস। জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁরা অনেকেই বুঝেছেন, ভালো বর্ষা হলে, ভালো চাষও হবে, হবে ভালো ফসলও কিন্তু তার মানেই আর্থিক উন্নতি নয়।
স্বাভাবিক বৃষ্টি কৃষকদের একমাত্র ভরসার জায়গা। ভালো বৃষ্টির ফলে ভালো ফসল হলেই যে তাঁদের বিশাল আয় হবে তা মোটেই নয়। বাজারে সেই ফসলের ভালো দাম নাও পেতে পারেন তাঁরা। এমন নয় যে চাহিদা কমেছে, কিন্তু আড়তদারদের খেলায় ফসলের দাম এত বাড়লো যে ক্রেতাদের তা নাগালের বাইরে চলে গেল। ক্রেতা কমলো এবং কৃষকরাও ফসলের দাম পেলেন না। অন্যদিকে বাজার বিশেষজ্ঞরা আবার দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা বলতে থাকেন। এতেও উৎপাদকদের ক্ষতি হয়। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে কাঁচা আনাজ, মাছ সবকিছুতেই এই খেলা চলছে। উৎপাদনে কৃষকের ভূমিকা থাকলেও তা বিপণন করায় কৃষকের কোনও ভূমিকা নেই। তাদের যেন হাত পা বাঁধা। এক মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেছেন তাঁরা।
আগে বর্ষা হলে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটতো, এখন আনন্দের পাশাপাশি থাকে আশঙ্কাও। এবারের বর্ষাতেও ‘এল নিনো’ সমস্যা বাড়াতে পারে যদিও তা এখন একটু দুর্বল। এল নিনো বর্ষার স্বাভাবিক ছন্দটা নষ্ট করে দেয়, তা হয়ে ওঠে খামখেয়ালি। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি দুটোই ফসলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক। ফসল তো নষ্ট হয়ই এমনকী কৃষকরা জমিতে লাগানো অর্থও তুলতে পারেন না, পরিশ্রমের কথা বাদই দিলাম। ফসল বাজারে পৌঁছনো দূরের কথা মাঠে থাকা অবস্থাতেই নষ্ট হয়ে যায়। এটা এমন একটা সমস্যা যে মাঝপথে অন্য কোনও চাষ শুরু করার উপায়ও থাকে না। দুরু দুরু বক্ষে আবার শুরু হয় আরেকটা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষার পালা।
চাষের ধরন বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে ক্ষেতের জল সিঞ্চনের ধরন। খরা কবলিত এলাকায় সমস্যার মোকাবিলার জন্য বিরাট ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চয়ী যোজনা চালু করা হয়েছিল। ২০১৯ এর মধ্যে ৯৯টি প্রোজেক্ট চালু হওয়ার কথা, হয়েছে মাত্র ৬টি। এবছর বৃষ্টি কম হলে ডালের দর বাড়তে পারে। কোনও সমস্যা দেখা দিলে ডাল রপ্তানির ব্যাপারে দ্রুত জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের।
গত তিন বছরে গোটা দেশজুড়েই অসংখ্য আবহাওয়াজনিত সমস্যার মোকাবিলা করেছেন দেশের কৃষকরা। যাঁরা একটু করিৎকর্মা তাঁরা সরকারের কাছ থেকে খয়রাতি বাবদ সাহায্য আদায় করেন। বিমা আছে কিন্তু তাতে ক্ষতিপূরণ বাবদ এত কম টাকা পাওয়া যায় যে তা খাটনি এবং খরচের তুলনায় কিছুই নয়। আগেই বলেছিলাম এবছর অবস্থাটা আরও খারাপ। কারণ খরার কারণে আগের বছরগুলিতে তাঁদের তেমন কোনও আয় হয়নি। এই মরশুমে তাঁরা যেন দাঁড়িয়ে আছেন এক খাদের কিনারায়। কৃষকরা একটা বিরাট শক্তি। তাঁদের আন্দোলনে দেশ নড়েচড়ে বসে কিন্তু এখন কাজ বাদ দিয়ে লড়াই করার মত অবস্থায় নেই তাঁরা। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীদের মত কোনও আর্থিক অনুদান ও ভর্তুকিও দাবি করতে পারেন না।
বর্ষা কৃষকদের জীবনে ডেকে আনছে বিপদ। তাঁরা যেন ভাগ্যের হাতে পরাজিত, ক্লান্ত যোদ্ধা। যাঁদের পরিশ্রম, রুটিরুজি সবই কেড়ে নিচ্ছে বর্ষার খামখেয়ালি। তাঁদের কথা শোনার লোকও কম, কমছে তাঁদের গলার জোর। একসময় সংখ্যার জোরে তাঁরা ছিলেন একটা বিরাট ভোটব্যাঙ্ক। সব রাজনৈতিক দল তাঁদের সমীহ করত, সংখ্যা কমায় এখন সেই দাপটও কমেছে। বার্ষিক রোমান্স নয়, বর্ষা এখন তাঁদের কাছে অনিশ্চয়তায় ভরা এক সময়।